বাংলাদেশের জন্মের পর তাঁর বেড়ে ওঠায় চারুকলা শিল্পী সমাজ নানা সময়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান রেখে গেছে। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে প্রথম সারিতে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও তাঁদের শিল্পকর্ম। জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, হামিদুজ্জামান খান, নিতুন কুন্ডু, দেবদাস চক্রবর্তী, আমিনুল ইসলাম, স্বপন চৌধুরী প্রমুখ শিল্পী সারা জীবন ধরে নানাভাবে বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে চিত্রায়িত করে গেছেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মিছিলে প্রথম সারিতে মুর্তজা বশীরের অবস্থান এখনো ঐতিহাসিক আলোকচিত্রগুলোতে কালের সাক্ষী। সব ধরনের সংগ্রামী মিছিলের ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড লেখা ও আঁকা ইত্যাদিতে অগ্রগামীর ভূমিকায় চারুকলার শিল্পীরা ছিলেন সদা সচেষ্ট। সংগ্রাম-পরবর্তী সময়ে এই চারুকলার শিল্পীরাই সব ঐতিহাসিক দিনগুলোকে দিয়েছেন এক শৈল্পিক রূপ। যেমন একুশে ফেব্রুয়ারি কখনোই পূর্ণতা পায় না চারুশিল্পীদের তৈরি আলপনা ছাড়া। বায়ান্নর পর একুশে ফেব্রুয়ারি সামনে রেখে শিল্পীরা নানা রকমের শিল্পকর্মকান্ড পরিচালনা করছেন। নানা সময়ের আয়োজিত চিত্র প্রদর্শনী ছাড়াও উল্লেখ করার মতো পঞ্চাশের দশকে তৈরি করা কামরুল হাসানের ‘অক্ষরবৃক্ষ’ নামক স্থাপনাশিল্পটি, এরপর নব্বইয়ের দশকে আমরা দেখি চট্টগ্রামে করা একুশে ফেব্রুয়ারিকে মাথায় রেখে শিল্পী ঢালী আল মামুনের করা একটি পরিবেশনাশিল্প (পারফরম্যান্স আর্ট)। এরই ধারাবাহিকতায় আরেকটি ভিন্ন আঙ্গিকের শিল্পকর্মকান্ডের উপস্থাপন দেখি ‘লাল’ নামক একদল শিল্পীর করা ‘আমাদের ভাষা আমাদের শহীদ’ নামক পরিবেশন কলার (পারফরম্যান্স আর্ট), যা ২০১১ থেকে পরিচালিত হচ্ছে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারির দিন সকালবেলায়। এই দলটির সদস্যদের মধ্যে একজন হচ্ছেন শিল্পী সঞ্জয় চক্রবর্তী, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক। চলুন, তাঁর কাছ থেকেই জেনে নেওয়া যাক এই কর্মকান্ডের যাবতীয় বিষয়ে।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দীপক রায়।
দীপক রায়: ‘লাল’-এর শুরুটা সম্পর্কে প্রথমে বলবেন।
সঞ্জয় চক্রবর্তী: কলকাতায় শিল্পশিক্ষা গ্রহণ করার সময় মূলত এই দলটি গঠনের চিন্তা মাথায় আসে। যেহেতু পরিবেশন কলা বা পারফরম্যান্স আর্ট পরিচালনার ক্ষেত্রে একাধিক মানুষের প্রয়োজন পড়ে, তাই সেই সময়ে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে এই দলটি গঠন করি। দলটির নাম ‘লাল’ দেওয়া কারণ ছিল যেহেতু ভাষা, পোশাক, আচার আচরণ ইত্যাদির ভিন্নতা আমাদের মধ্যে ভেদ তৈরি করে কিন্তু রক্তের রঙের মাধ্যমে আমরা সকল মানুষ একত্র তাই দলটির নামই রাখা হয়েছিল ‘লাল’।
দীপক রায় : বাংলাদেশে আসার পর এই দল কীভাবে এর কর্মকান্ডের ধারাবাহিকতা রাখল?
সঞ্জয় চক্রবর্তী : কলকাতা থেকে আসার পর ২০০৯ সালে নারায়ণগঞ্জ আর্ট কলেজে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে আমি যোগদান করি। একই সঙ্গে শুরু করি একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষকতা। একই সমাজের দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাব্যবস্থার যে হেরফের, তা আমাকে দারুণভাবে নাড়া দেয়। স্কুলের কিছু ছাত্রছাত্রীর মধ্যে বাংলার যে একধরনের পোশাকি ব্যবহার, তাও আমাকে পীড়া দিতে থাকে। ২০১১ তে আমার নারায়ণগঞ্জ আর্ট কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমি মূলত এই দলটির আবার আনুষ্ঠানিক সূচনা করি। ওই বছরই ‘আমাদের ভাষা আমাদের শহীদ’ নামক পরিবেশন কলার উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে ‘লাল’ এর কর্মকান্ডের আনুষ্ঠানিক কর্মকান্ড শুরু হয়।
দীপক রায়: পারফরম্যান্সটির মূল কর্মকান্ড কী হয়ে থাকে?
সঞ্জয় চক্রবর্তী : একুশে ফেব্রুয়ারি সকাল আটটার মধ্যে আমরা সবাই সাদা পোশাক পরে বাংলা একাডেমির ভাষাশহীদের ভাস্কর্যের কাছে একত্র হই। যে জায়গাটিতে আমরা সাধারণত মিলিত হই তা হলো ‘লেখক আড্ডা’ নামক শহীদ ভাস্কর্যের পেছনের ঘরটিতে, যা প্রতিবছর তৈরি করা হয়ে থাকে। যেহেতু লেখক, সাহিত্যিক, কবিরাই আমাদের ভাষার সঞ্চালক ও বাহক, তাই সেখান থেকেই আমাদের প্রথম একত্র হওয়া। এরপর আগত শিল্পীদের মধ্যে পাঁচজন সেই সময়ই নির্ধারিত হয়, যারা পারফরম্যান্সটির মূল কর্মকান্ডটির অংশ পরিচালনা করে। পাঁচজন শিল্পীকে অন্যান্য শিল্পী মুখোশ পরিয়ে দেয় এবং লাল রঙের বর্ণমালা লাল ফিতা দিয়ে বেঁধে দেয় শরীরের বিভিন্ন অংশে। যে পাঁচজন শিল্পী মুখোশ ও বর্ণমালা শরীরে ধারণ করে, তারা মূলত প্রতীকায়িত করে পাঁচজন ভাষাশহীদকে। পারফরম্যান্সের শুরুতে সকাল নয়টার দিকে এই পাঁচজন শিল্পী এবং বাকি শিল্পীরা খালি পায়ে লেখক মঞ্চ থেকে বের হয়ে শহীদ ভাস্কর্যকে পাঁচবার প্রদক্ষিণ করে। প্রদক্ষিণ শেষে তারা বাংলা একাডেমি থেকে শহীদ মিনারের উদ্দেশে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। পারফরম্যান্সের এই অংশে শিল্পীরা শ্রেণি, বর্ণ, পেশানির্বিশেষে সমাজের সকল স্তরের লোকদের মাঝে লাল বর্ণমালা বিলিয়ে দেয়।
দীপক রায় : ভাষাকে নিয়ে এই ধরনের কর্মকান্ডের ভাবনা কীভাবে আপনার মাথায় এসেছিল?
সঞ্জয় চক্রবর্তী : প্রথমেই বলেছিলাম, কীভাবে বাংলা ভাষার দৈন্য দেখে আমার মন পীড়িত হয়েছিল। যে ভাষার জন্য আত্মত্যাগের কারণে আজ সারা বিশ্ব বাঙালিকে আলাদা করে চিনে নিচ্ছে। যে ভাষা পৃথিবীর অনেক ভাষার চেয়েও সমৃদ্ধ, যে ভাষায় সাহিত্য আর দর্শনের চর্চা যেকোনো ভাষাকে নির্দ্বিধায় টেক্কা দিতে পারে এবং সবশেষ কথা যে ভাষার জন্য একটি জাতি তার প্রাণকে অবলীলায় বন্দুকের সামনে ঠেলে দিয়েছে, সেই ভাষার আজ কী অবস্থা? একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল, এই পরিস্থিতিতে একজন শিল্পীর কী করণীয়, যা সে তার দায়বদ্ধতা থেকে করতে পারে। এই চিন্তা থেকেই মূলত কাজটির পরিকল্পনা মাথায় আসে।
দীপক রায় : অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের ব্যাপারে কিছু বলুন।
সঞ্জয় চক্রবর্তী : প্রথমবার আমি নিজেই পাঁচজন মূল শিল্পীর একজন হয়ে অংশগ্রহণ করেছিলাম পারফরম্যান্সটিতে। কিন্তু এর পরের বছর থেকেই এত বেশি ছাত্র, ছাত্রী তাদের বন্ধুবান্ধব ও অন্যান্য শিল্পী স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে যে আমার পক্ষে আর শহীদ শিল্পী হিসেবে অংশগ্রহণ সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ কারণে দ্বিতীয় বছর থেকেই শহীদকে প্রতীকায়িত করা পাঁচজন শিল্পী পরিবর্তিত হতে থাকে। যেমন গত বছর শুধু শিশুরাই শহীদ শিল্পী হিসেবে অক্ষর বিতরণ করেছিল।
দীপক রায় : সাধারণ মানুষের কেমন সাড়া পান?
সঞ্জয় চক্রবর্তী : এককথায় অভাবনীয়। একুশে ফেব্রুয়ারির দিন এমনিতেই বিপুল লোকজন আসে। সবারই একটাই লক্ষ্য থাকে- শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া কিন্তু শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা যে অন্যভাবেও জানানো যেতে পারে, তা তাদের অনেক ভাবনার মধ্যে থাকে না। ফলে আমাদের পারফরম্যান্সটি যখন চলতে থাকে তখন প্রচুর প্রশ্ন সাধারণ জনগণের কাছ থেকে আমরা পাই।
দীপক রায় : কখনো কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছেন?
সঞ্জয় চক্রবর্তী : আমার কাছে সবচেয়ে বড় সহযোগিতা প্রত্যেক বছর আসা আমার অগুনতি ছাত্রছাত্রী, যারা আমাকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আসার আগে থেকেই ফোন করে খোঁজ নেয় যে ‘স্যার, এই বছর পারফরম্যান্স হচ্ছে তো। আমি কিন্তু স্যার সকাল সকাল পৌঁছে যাব।’ এখন এই পারফরম্যান্সটি মূলত আমার ছাত্রছাত্রীরাই আয়োজন করে। ‘লাল’-এর মাধ্যমে পারফরম্যান্সের মূল তত্ত্বাবধানের জায়গায় থাকে আমার ছাত্রছাত্রীরা। প্রতিবছর তাদের ভালোবাসা যে পারফরম্যান্সটিকে টিকিয়ে রেখেছে, এটাই সবচেয়ে বড় সহযোগিতা।
দীপক রায় : কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আছে পারফরম্যান্সটি নিয়ে?
সঞ্জয় চক্রবর্তী : একজন শিল্পী সর্বতোভাবে চায় তার শিল্প অনেকের মধ্যে বেঁচে থাকুক বা কালোত্তীর্ণ হোক। স্বাভাবিকভাবে আমিও তা প্রত্যাশা করি। এই পারফরম্যান্সটিতে যত বেশি লোক অংশগ্রহণ করবে, তত এর সার্থকতা বৃদ্ধি পাবে। প্রতীক রূপে বাংলা বর্ণমালা মানুষের প্রাণে প্রাণে ছড়িয়ে যাবে- এই প্রত্যাশা সার্বিকভাবে আমি ও ‘লাল’-এর সদস্য শিল্পীরা আশা করেন।
No Comments