ভারতীয় চলচ্চিত্রনির্মাতা মনি কাউল। প্রথম ছবি থেকেই তাঁর গায়ে ট্যাগ লাগে বিতর্কিত ও দুরূহ পরিচালকের। তাঁর সম্পর্কে মিশ্র মনোভাব ভারতীয় দর্শক, সমালোচক ও চলচ্চিত্র পরিচালকদের।
মনি কাউলের সিনেমার বিষয়বস্তু ভারতীয় ধ্রুপদি উৎসের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। তাঁর সিনেমায় ধ্রুপদি সংগীতের ব্যবহার অথবা লোকায়ত কাহিনির আশ্রয় ভারতীয় সংস্কৃতির শিকড়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের প্রমাণ। শিল্পায়নের যুগে তিনি কৃষ্টি আঁকড়ে ধরে একের পর একই সিনেমা তৈরি করেন। তাঁর সিনেমার স্থান এবং কাল উপমহাদেশের চিরায়ত স্থান অথবা পাত্র আকারে এসেছে। মনি কাউলের চলচ্চিত্র যেন এক দীর্ঘ ধ্রুপদি সংগীত।
মৃণাল সেন উসকি রুটির গুরুত্ব মেনে নিয়েও ভয় পেয়েছিলেন এই ভেবে যে, মনির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ফ্যাসিবাদের প্রতি না অনুগত হয়ে পড়ে। আর সত্যজিৎ রায় প্রকাশ্যে বিদ্রূপ করেছিলেন এই বলে যে, মনি কাউল, কুমার সাহানী তাঁদের দীক্ষাদাতাদের কাছ থেকে রসবোধের অভাব ছাড়া আর কিছুই শেখেননি। আর এই দীক্ষাগুরু ঋত্বিক ঘটক আশা প্রকাশ করে বলেছিলেন, আড়ষ্টতা ও প্রদর্শনবাদ কাটিয়ে বুদ্ধিমান মনি কাউল ক্রমেই নিজস্ব অভিব্যক্তি খুঁজে পাবেন। এই তিনজনের মন্তব্য মনি কাউলের স্বস্তি বা অস্বস্তিও কারণ যা-ই হোক না কেন, কেউ তাঁকে অস্বীকার করতে পারছে না।
অনেক সমালোচকের মতে, মনি কাউল সচেতনভাবে ভারতীয় চলচ্চিত্রের দৃশ্যের সঙ্গে কাঠামো ও বক্তব্যের সঙ্গে বর্ণনার সম্পর্কের উন্নয়ন করেছেন। তিনি অবজেক্টকে সার্থকভাবে সিনেমাটিক অবজেক্টে পরিণত করেছেন। মনি কাউল ও কুমার সাহানি ভারতীয় চলচ্চিত্রে এই ইচ্ছা পরিবর্তন উপমহাদেশের সিনেমা ভাষায় নতুন লিখন শুরু করে। মনি কাউল এক সাক্ষাৎকারে বলেন, মূলত ব্রেসোর পিকপকেট দেখার পর, সিনেমা ভাষা সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়।
কাশ্মীর থেকে আসা এক রাজস্থানী পরিবারে ১৯৪২ সালে মনি কাউলের জন্ম। অভিনেতা ও পরিচালক মহেশ কাউল তাঁর চাচা। পুনে চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠানে প্রথমে অভিনয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন তিনি। কিন্তু মন পরিবর্তন করে সিনেমা নির্দেশনা ও পরিচালনা নির্বাচন করেন। তিনি ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া থেকে ১৯৬৬ সালে সিনেমা পরিচালনার বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
মনি কাউল ছিলেন ভারতের আরেক খ্যাতনামা পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের সরাসরি শিষ্য। তবে যখন তিনি সিনেমা তৈরি করেন তখন ঘটকের সিনেমার ধারেকাছেও ছিলেন না। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমি ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি।
তাঁর নির্মিত প্রথম সিনেমা উসকি রুটি (১৯৬৯) ভারতীয় চলচ্চিত্রে নবযুগের সুচনা করে; যা সিনেমার দর্শককে গোলকধাঁধায় ফেলে দেয়। কারণ, কাঠামো অথবা বর্ণনারীতিতে উসকি রুটি আগের সব সিনেমা হতে আলাদা। যদিও সিনেমাটি ভারতের বিখ্যাত লেখক মোহন রাকেশের গল্প অবলম্বনে তৈরি, কিন্তু তিনি লেখকের একতরফা বর্ণনা রীতি অনুসরণ না করে ফরাসি পরিচালক রবার্ট ব্রেসো দ্বারা অনুপ্রাণিত এক নতুন বর্ণনারীতির প্রকাশ করেন। সিনেমাটি মুক্তির পরপর ভারতীয় জনপ্রিয় মিডিয়ার আক্রমণের শিকার হয় এবং অপরদিকে চলচ্চিত্রবোদ্ধা মহলে প্রশংসিত হয়।
যথেষ্ট যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও মনি কাউলকে বলা যেতে পারে ভারতীয় চলচ্চিত্রের অদৃশ্য সিনেমা পরিচালক। উপমহাদেশের দর্শক তাঁর সিনেমাকে ইউরোপীয় অথবা ভিন গ্রহের, না হয় বোঝা যায় না অপবাদে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। তাঁকে আত্মীয় মনে না করার আর একটা কারণ হতে পারে, তিনি সত্যজিৎ রায় থেকে ভিন্ন। তবে কৌতূহল জাগানোর বিষয় হলো বিদেশি সমালোচকেরা মনে করেন, তিনি সত্যজিৎ রায়ের উত্তরসূরি অথবা প্রতিস্থাপন হতে পারেন।
মনি কাউলের পঁচিশ বছর বয়সে করা কাব্যিক ছবির নাম উসকি রুটি (১৯৬৯), গ্রামের এক গৃহবধূর গল্প। সে প্রতিদিন রুটি নিয়ে প্রধান সড়কে বাস ড্রাইভার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে। এই অপেক্ষার গল্পে দৃশ্যের সঙ্গে দৃশ্যের সংযোগ অথবা অবজেক্টের ব্যবহার ভারতীয় সিনেমা ব্যাকরণে নতুন অধ্যায়। সাদাকালো সিনেমাটি ভারতীয় নারী রূপায়ণে মৌখিক অভিব্যক্তি অপেক্ষা মনোজাগতিক আবেগের প্রকাশ করে। তাই সিনেমা ভাষা অধিকাংশই বিমূর্ত এবং যা হয়তো ভারতীয় দর্শকের অস্বস্তির কারণ।
মনি কাউলের দুবিধা (১৯৭৩) ভারতীয় নববিবাহিত বধূর ভূতের সঙ্গে প্রেম নিয়ে তৈরি। তাঁর সিনেমার ভূত হয়তো ভারতীয় নারীর অতীত তথা কোমল শৈশব এবং অপরদিকে বর্তমানে স্বামী গৃহের চাপিয়ে দেওয়া নিয়মকানুন। চরিত্রের নানা ঘাত-উপঘাত এবং কাহিনির পদে পদে বাক চলচ্চিত্রটিকে সার্থক করেছে।
তাঁর অন্যান্য সিনেমার মধ্যে সাথাছে উথাছা আদমি ১৯৮০, ধ্রুপদি (১৯৮২), মানস মাটি (১৯৮৫) এবং ভারতীয় প্রখ্যাত ধ্রুপদি সংগীতশিল্পীর জীবন নিয়ে বানানো ডকুমেন্টারি সিদ্ধেশ্বরী ১৯৮৯ সালে মুক্তি পায়। এ ছাড়া নাজার ১৯৮৯, নোকার কি কামিজ ১৯৯৯ উল্লেখযোগ্য। তাঁর সর্বশেষ ছবি এন এপস রিজেনজাস ২০০৫।
১৯৭৪ সালে মনি কাউলের দুবিধা এবং ১৯৮৯ সালে ডকুমেন্টারি সিদ্ধেশ্বরী জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। ২০১১ সালের ৬ জুলাই ৬৬ বছর বয়সে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের এই নিঃসঙ্গ নির্মাতা।
No Comments