[metaslider id=1026]
।ইকবাল বাহার চৌধুরী। শীতের বিদায় ঘণ্টায় সকালের স্নিগ্ধতা রঙ পরিবর্তন করে। আর যাদের মনে আফুরন্ত রঙ- তাদের শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, বসন্ত, হেমন্ত, আনন্দ-বেদনা সবকিছুই যেন রঙ পরিবর্তনের উৎসব উৎসব খেলা। এই ফেইসবুক যুগে রাতজাগা পাখিদের সকাল আগের মত রঙ্গিন নয়, কিছুটা মলিন। বিশ্বকাপের তেজ ছড়ানো অস্থির ছুটির দিন !
সকাল ৮ টা বাজতেই উষ্ণতর দিনের স্পষ্ট আভাস। সদ্য বিসর্জন দেওয়া ঘুমের চিহ্ন নিয়ে হাজির কয়েক জোড়া লাল চোখ। সবার আগে সাদাকালো দাড়ি-চুলের ‘ইন মোশন’ রূপকার আর একজন স্বপ্নচারী শিল্পীবন্ধু।
একদল তরুণ শিল্পীর কর্মক্ষেত্র ‘আউটডোর আর্টিস্ট কমিউনিটি’।
আউটডোরের যাত্রা শুরু হয় ২০০৯ সালের ১২ ডিসেম্বর। এই আর্টিস্ট কমিউনিটির অভিষেকে ছিলেন শিল্পী মানিক বণিক, রুমানা রহমান (রানী) ও মীরা রহমান। প্রথম ৬মাস এই তিন তরুণ শিল্পী ঢাকার বিভিন্ন স্পটে গিয়ে সে এলাকার ল্যান্ডস্কেপ ও রিভারস্কেপ রেখা কিংবা তুলির আঁচড়ে শৈল্পিক ভাষায় রূপ দেন। ২০১০ সালের দিকে যুক্ত হন আঁখি, মাহমুদা, আলী নয়ন, আরাফাত ও সৈকত। এরপর পথ চলা নিরবধি। অন্য দশটা শিল্পীগোষ্ঠীর মত আউটডোরের চলার পথও সবসময় মসৃণ ছিল না। ছিল শুধু অদম্য ইচ্ছে। ২০১১ সাল থেকে মাঝে মধ্যে আউটডোরের সঙ্গী হয়েছেন অনেক স্বনামনধন্য শিল্পী। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শিল্পী শহীদ কবির, শিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামী, শিল্পী অভি শংকর আইন, শিল্পী সুমন ওয়াহিদ ও শিল্পী ঝোটন চন্দ্র রায় প্রমুখ।
এইক্ষণে আসা যাক আউটডোর আর্টিস্ট কমিউনিটির এবারের আয়োজনে। গত ১৩ মার্চ ২০১৫ পুরান ঢাকার বাবুবাজার ঘাটে হয়ে গেলো রঙ নিয়ে আউটডোর এবারের মাস্তি। পূর্বঘোষিত সময় অনুযায়ী সকাল ৮ টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী ছাড়াও ঢাকা আর্ট কলেজ, নারায়ণগঞ্জ আর্ট কলেজ এবং ইউডা চারুকলার বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। এই আয়োজনের অতিথি শিল্পী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের তরুণ শিক্ষক শিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামী। সকাল ৮ টা ৪৫ মিনিটের দিকে পূর্বনির্ধারিত স্থানে একঝাক দর্শকের উৎসুক দৃষ্টিকে সামনে রেখে বিশেষ পদ্ধতিতে তেল রঙের কাজের সূচনা করেন শিল্পী বিশ্বজিৎ। সাধারণ মানুষের আগ্রহ, বিচিত্র প্রশ্ন, বিনোদনের উপলক্ষ শিল্পী এবং শিল্প যে আবহের জন্ম দেয় তার প্রয়োজন আছে শিল্পের বিকাশের স্বার্থে কিংবা সাধারণ মানুষের মননশীলতার বিকাশের স্বার্থে। মাত্র ২০ মিনিটে চমৎকার একটি রিভারস্কেপ শেষ হলে তা তরুণ শিল্পীদের এবং দর্শকের মাঝে উৎসাহের মাত্রা বহুগুনে বাড়িয়ে দেয়। তারপর সামান্য দূরে অবস্থিত দুটি অলস সময় পার করছে এমন জাহাজে ছড়িয়ে পড়ে প্রায় ২৫ জন তরুণ-তরুণী। শুরু হয় উষ্ণদিনের রঙ্গিন কর্মযজ্ঞ অনেকটা চড়ুইভাতি মেজাজে। চারপাশে প্রচুর মানুষ, নৌকা, ট্রাক, গাড়ির হর্নের শব্দ, বুড়িগঙ্গার জীর্ণদেহ আর কালো পানি। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ একটি এলাকায় শিল্পচর্চা কতটা কঠিন ও চ্যালেঞ্জের তা বাংলাদেশী এসব অদম্য শিল্পীদের চেয়ে বেশি কে জানে? জাহাজের ভেতরটায় যেখানে ভ্যাপসা গরম সেখানেও হানা দিয়েছে কিছু উৎসুক জনতা ও বুড়িগঙ্গার আশ্রয়-প্রশ্রয় আর অবহেলায় বেড়ে ওঠা কিছু দাপুটে টোকাই। এদিকে একের পর এক বড় সাইজের নিরীক্ষাধর্মী রিভারস্কেপ এঁকে যাচ্ছেন শিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামী। সেকাজ মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন তরুণ শিল্পীরা। এরপর একটু এদিক-ওদিক উঁকি দিয়ে বিষয় নির্বাচন শেষে সবাই নিজ নিজ ঝুলি থেকে বের করতে লাগলেন রং-তূলির ভাণ্ডার! সে যুগের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা আর এ যুগের তূলিওয়ালা … এ নদী মাতৃকা যেন সব গল্পের সাক্ষী ! হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে প্রায় দুশ বছর আগে যে নদীর গল্প লিখেছিলেন তূলির ভাষায় চার্লস ডয়’লী সেখানে আজ বসে আঁকছেন জয়ন্ত মণ্ডল! এখানেই শিল্পের শক্তি। একই নদী- পাল্টেছে দৃশ্যপট, বদলেছে পরিবেশ। শিল্পীরা যুগে যুগে যেমন রাঙ্গিয়েছেন তেমনই প্রয়োজনে চোখও রাঙ্গিয়েছেন তীর্যক শিল্পভাষায়। চলছে নদীর বুকে আঁকি-বুকি। এ গঙ্গাবুড়ির সন্তান ঢাকা। চিরকুটের গানে , ” মিছে হাসি , মিছে কান্না / পথে পথের আড়ালে / গ্রিন সিগনাল, রেড ওয়াইন / দেয়ালে, দেয়ালে .. / এ শহর, জাদুর শহর…”। জাদুর শহরে আপন মনের উষ্ণতার মিশেলে উজ্জ্বল রঙে গঙ্গাবুড়ির যৌবণের গান গেয়েছে তরুণ শিল্পী রিগান ও আজমলের ক্যানভাস। নদীর অস্থিরতা মুনের তূলি সঞ্চালনায়, কান্নার জল যেন বিশ্বজিৎ গোস্বামীর গতিশীল রেখা ভেদ করে গড়িয়ে পড়া রঙ। অতীতের নীল জলের প্রতি এখনও পক্ষপাত মানিক, শচি ও সীমান্তদের কাজে। তবে দৃশ্যমান কালচে পানি আঁকতে ভুলেননি জয়ন্ত মণ্ডল।
দিনজুড়ে তরুণ শিল্পীদের এই কর্মযজ্ঞে অংশ নেওয়া শিল্পীরা হলেন- বিশ্বজিৎ গোস্বামী, মানিক বনিক, হাবিব সোহাগ, জয়ন্ত মণ্ডল, রাহুল রাহাত, দীপ্তি ঘোষ, নুশরাত জাহান তিতলী, এডওয়ার্ড আর্থার, মুন রহমান, তানিয়া রহমান, ইমাম হোসেন মিশু, আব্দুর রহমান নূর, সাখাওয়াত হোসেন রনি, আদিল হাসনাত, ফারহান শাহারিয়ার, কপিল চন্দ্র রায়, আজমল হোসেন, প্রীতম মজুমদার, রফিকুল ইসলাম রবি, তানভীর মাহমুদ শচি, নাদিয়া চৌধুরী, পারভেজ হাসান রিগান ও জয়ন্ত সরকার।
চোখ বন্ধ করে মেমোরীতে গিয়ে ১৩ই মার্চের ফাইলটা ওপেন করলেই এখনো ভেসে আসে চারুকলার ছোট পুকুর পাড়ে ঘুম ঘুম লাল চোখ…, মিষ্টি হাসি, সাদাকালো দাড়ি-চুলের তরুণ শিক্ষক, রিক্সায় কানে হেডফোনে খেলার ধারাভাষ্য, বাবুবাজার ঘাটে তিতলীর বিশেষ ভঙ্গিমায় ‘সাঁকো’ পাড়ি দেওয়া, রিগানের উড়ন্ত ক্যানভাস! বিশ্বজিৎ গোস্বামীর বিশেষ ভঙ্গিতে সেলফি… ভিড়ের মাঝে নিজেকে লুকিয়ে আবার ফেরত আসেন মানিক বনিক! এ গল্প জানা আছে আউটডোরের সবার কাছে… ফেইসবুকে, কাজে আর দূরন্তপনায়। উচ্ছ্বল দূরন্তপনার নামই জীবন। আর এই হলো আউটডোর আর্টিস্ট কমিউনিটির বুড়িগঙ্গায় চিত্রভ্রমণ। ছবি আঁকা শেষে গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফেরা। মনে পড়ে কবি ও শিল্পী কফিল আহমেদের গাওয়া গান-
গঙ্গাবুড়ি গঙ্গাবুড়ি শোন
এতো সুন্দর নামটি তোমার কে দিয়েছে বল…
No Comments