সম্ভবত পৃথিবীর অন্যতম কঠিন কাজ অনুভূতির সহজ প্রকাশ। উপলব্ধির যথার্থ আবেদন উন্মোচন খুব সহজ কাজ নয়। রঙে-রেখায় অনুভবের রূপ-রস তুলে ধরা তো আরও কঠিন কাজ। সেই কাজটিই করার চেষ্টা করছেন শিল্পী কায়সার কামাল, তাঁর অনবদ্য চিত্রকর্মে।
গ্যালারি টোয়েন্টিওয়ানে কায়সার কামালের একক চিত্র প্রদর্শনী ‘realm of perception’-এ ঠাঁই পাওয়া ৪০টি চিত্রকর্ম যেন অনুভূতির নানা ব্যঞ্জনা নিয়ে তাকিয়ে আছে। কায়সারের অনুভূতির অন্তর্জগতে নানা রঙে, নানা ঢঙে ফুটে উঠেছে জীবন। মিশ্রমাধ্যমে করা চিত্রকর্মগুলো চিত্রকরের স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ করে।
নিউইয়র্কপ্রবাসী শিল্পী কায়সার কামালের কাজ মূলত নিরীক্ষাধর্মী। যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা, মানুষ এবং প্রকৃতি তাঁর ছবিতে এসেছে বিবিধরূপে। নানা ধরনের মাধ্যমে তিনি কাজ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ড্রয়িং, পেইন্টিং, ফটোগ্রাফি, ম্যুরাল, স্ক্রল, পেইন্টিং, ভিডিও ইত্যাদি।
শিল্পী রফিকুন নবী বলেন, একজন শিল্পী পর্যায়ক্রমে পরিপক্বতার দিকে এগিয়ে যায়। প্রতিটি কাজেই নতুনভাবে উপস্থাপিত হন শিল্পী। কায়সারের এই সিরিজের কাজগুলোর উল্লেখযোগ্য দিক হলো রশ্মির ব্যবহার। বিভিন্ন অর্থবোধকতা মূর্ত হয়েছে রশ্মির বিবিধ ব্যবহারে। উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার যেমন চোখে পড়ার মতো, তেমনি ধূসরতাও উল্লেখযোগ্য। তবে সবকিছুরই পরিশীলিত প্রয়োগ ঘটিয়েছে কায়সার। অনুভূতি কিংবা অভিব্যক্তি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারা শিল্পীর জন্য কৃতিত্বের বটে। প্রদর্শিত চিত্রকর্মগুলোতে শিল্পীর কাজের ধারা কিছুটা হলেও বোঝা যায়। নিরীক্ষাধর্মী কাজ বরাবরই চ্যালেঞ্জিং। শিল্পী সাহসের সাথেই সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন। দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকেও শিল্পচর্চায় নিবিষ্ট কায়সার কাজের মধ্যে দেশকে ধারণ করে আছে। উদীয়মান চিত্রশিল্পীরাও তার এই প্রদর্শনী দেখে অনুপ্রাণিত হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলায় স্নাতকোত্তর কায়সার কামালের প্রথম একক প্রদর্শনী হয় ২০০০ সালে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। এ পর্যন্ত ৬টি একক প্রদর্শনী ছাড়াও অনেক দলীয় প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন তিনি। প্রবাসে আছেন দীর্ঘদিন ধরে। পেশাগত কারণে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকলেও শিল্পের সংসর্গ ছাড়েননি। ছবি আঁকার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন নিবিড় চর্চায়। ছবি আঁকার নেশা এখন পেশাও বটে তাঁর। আমেরিকার এস্টোরিয়ায় গড়ে তুলেছেন আর্ট গ্যালারি আর্টিস্টরান। এখানে বাঙালি শিল্পীরা প্রদর্শনীর সুযোগ পাচ্ছেন। এ ছাড়া বিদেশি আর্টিস্টরাও এখানে প্রদর্শনী করে থাকেন।
দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার ফলে ছবি আঁকায় কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না জানতে চাইলে শিল্পী কায়সার কামাল বলেন, কিছুটা পরিবর্তন আসা স্বাভাবিক। চোখের সামনের দৃশ্যপট তো অনেকটা প্রভাবিত করে। তবে প্রবাসে আছি বলে আমি নিজেকে বিচ্ছিন্নও মনে করি না। যেখানে আমি জন্মেছি, বেড়ে উঠেছে, সেই পরিবেশ-প্রতিবেশের প্রভাবই বেশি আমার মধ্যে। আমি এখনো ছবি আঁকতে গেলে বাংলাদেশের জীবন ও প্রকৃতিকেই অনুভব করি তীব্রভাবে। রং নির্বাচনেও এটা ভূমিকা রাখে অনেকখানি। প্রথম যখন দেশের বাইরে আসি, আমার যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য এখানকার একটি আর্ট প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছিলাম। কয়েক দিনেই বুঝতে পেরেছি, দেশ থেকে আমি যা শিখে এসেছি, তা কোনো অংশেই কম নয়। একদিন এক শিক্ষক আমাকে বললেন, তুমি কেন এখানে ভর্তি হয়েছ, তোমার অংকন জ্ঞান তো বেশ ভালোই। সেই থেকে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। এবং আমি কাজ করতে শুরু করি উৎসাহের সাথে। প্রবাসে কাজ করার তৃপ্তি-অতৃপ্তি দুটোই আছে। তবে কাজের ক্ষেত্রে কোনো কিছুই বাধা নয়, যদি ইচ্ছেটা প্রবল হয়।
প্রদর্শিত চিত্রকর্ম প্রসঙ্গে কায়সার বললেন, এই প্রদর্শনীর সব চিত্র নিরীক্ষামূলক কাজের একটি অংশ। এর মধ্য দিয়ে আমি মনের অনুভূতি কিংবা উপলব্ধির প্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা করেছি। যার ভেতর উঠে এসেছে প্রেম, ভালোবাসা, বিচ্ছেদ, ঘৃণা বা বিদ্বেষের প্রতিচ্ছবি। বাদ পড়েনি লোভ-লালসাও। প্রতিক্ষণে, প্রতি মুহূর্তে মানুষের অনুভূতি ও চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন আসছে, সেই পরিবর্তনকেও আমার চিত্রকর্মের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। চিত্রকর্মগুলো আমার নিজস্ব অনুভবের ফসল। আমি আমার উপলব্ধি থেকে বিভিন্ন রকম অনুভবের স্বরূপ তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এগুলোকে যে যেভাবে ব্যাখ্যা করতে চায়, আমার আপত্তি নেই। এই প্রদর্শনীর সব কাজ মিশ্রমাধ্যমে করেছি। মিশ্রমাধ্যমে কাজ করতেই আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কারণ এতে আমার ভাবনা ছবিতে প্রতিফলিত করতে পারি সহজে।
কায়সার কামালের চিত্রকর্মগুলোতে আছে জীবন ও প্রকৃতির প্রতিচ্ছায়ার বিভিন্ন দিক। একই সিরিজের প্রতিটি ছবিতে তাই বিষয় বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। এই সিরিজের চিত্রকর্মগুলো নির্দিষ্ট একটি থিম নিয়ে করা হয়েছে যদি, তবু এতে ফুটে উঠেছে অনুভবের বিচিত্র খেলা। একেকটি ছবি আলাদা আবেদন নিয়ে মূর্তমান হয়েছে।
গত ১৪ নভেম্বর গ্যালারি টোয়েন্টিওয়ানে প্রদর্শনীটির উদ্বোধন করেন ঢাকায় নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা ও বাংলাদেশের বরেণ্য চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী। প্রদর্শনী চলবে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত, প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা।
No Comments