। শিবানী কর্মকার শিলু ।২০১২ তে ১ এপ্রিল যাত্রা শুরু হয় মনোভুমি আর্ট স্পেস-এর। ইসরাত জাহান কাকন ও মাসুদুর রহমান যৌথ উদ্যগে শুরু করেন এ শৈল্পিক যাত্রা। সেই থেকে ক্রমশ সামনের দিকে ধাবিত হয়ে চলেছে এর উদ্দেশ্যের সফল প্রয়াস। উদ্দেশ্য সভ্যতার যে দর্শন আমরা মনে ধারণ করি, তারই চাষাবাদ করে ফসল ফলানো। মনোভূমি শিল্পীদের নিয়ে কাজ করছে যেমন সানন্দে তেমনি সচ্ছন্দ বোধ করেন শিশুদের নিয়ে কাজ করতে। শিশুদের সঙ্গে নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করেন তারা। এই প্রজ্নমের মনে সংস্কৃতির বীজ বপন করাই তাদের উদ্দেশ্য।
সম্প্রতি মনোভুমি আর্ট স্পেস-এর আয়োজনে মনোভুমি আর্ট স্পেস-এর গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয় ‘জল রঙের প্রতিচ্ছবি’ শীর্ষক প্রদর্শনী। নবীন ও প্রবীন মিলিয়ে আট জন শিল্পী এ প্রদর্শনীতে অংশ নেন। শিল্পীরা হলেন তরুণ ঘোষ, রা কাজল, রসিদ আমিন, শহীদ আহমেদ মিঠু, সোহেল প্রানণ, ইসরাত জাহান কাকন, মাসুদুর রহমান এবং জাহিদ হোসেন।
২৩ জানুয়ারি ২০১৪ ছিল এ প্রদর্শনীর উদ্বোধনী দিন। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন বরেণ্য শিল্পী আবুল বারক্ আলভী এবং শিল্পী শহিদ কবীর। আলোচক হিসেবে ছিলেন বিশিষ্ট শিল্প সমালোচক মইনুদ্দিন খালেদ। এ প্রদর্শনীর ব্যপ্তিকাল ছিল ৩১ জানুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত।
চার দিনের একটি আর্ট ক্যাম্পের আয়োজন করে মনোভুমি আর্ট স্পেস। কিছুটা গবেষনাধর্মী কাজের লক্ষ্য নিয়ে আয়োজিত হয় মনোভুমি আর্টস্পেস-এর এ ক্যাম্প। ওয়াটার বেইজ কালার নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে অতপর রঙের বৈচিত্রে চিন্তার বহিপ্রকাশ ঘটান শিল্পীরা। গবেষনাধর্মী কাজের ব্যাপারে মনোভুমি আর্টস্পেস বরাবরই একটা ভূমিকা পালন করে আসছে।
প্রদর্শনীতে শিল্পী তরুণ ঘোষ ‘Water Color Image’ যার অর্থ “জল রঙের ছবি” শিরোনামে বেশ কিছু কাজ করেন। এ প্রদর্শনী নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা বলেন শিল্পী তরুণ ঘোষ- ‘জলরঙ মাধ্যমটি সবাই গতানুগতিক ধারার মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলেছে। অথচ এর ব্যপ্তি অনেক। জলরঙের মাধ্যমে বহুমাত্রিক কাজ করা সম্ভব। জয়নুলের কাজে বিভিন্ন ভাবে জলরঙের তাৎপর্য লক্ষ্য করা যায়। দেশের বাইরে তাকালেও দেখা যাবে অনেক শিল্পী জলরঙের মাধ্যমে ভিন্ন মাত্রার কাজ করছেন। আমার সব কাজের মধ্যেই একটা জার্নি থাকে। কখনও তার অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় রূপক অর্থে। এবং সমসাময়িক প্রেক্ষাপট আমার কাজের একটা মূল বিষয়। এই কাজগুলোতে দেশের বর্তমান পরিস্থিতির বিভিন্ন এলিমেন্টস ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাবে কাজে উঠে এসেছে। রঙের ক্ষেত্রে এখানে পাওয়ার রঙের ব্যবহার করেছি। অনেকগুলো বিষয় এসে একটা বিষয়ে প্রকাশ পেয়েছে।’
দীর্ঘদিন যাবত ডেনমার্কে অবস্থান করছেন শিল্পী রা কাজল। সেখানেই চর্চিত হয় তার শিল্পযজ্ঞ। এরই মাঝে প্রায়শই ছুটে আসেন দেশে, আসেন প্রাণের টানে। দেশে অবস্থান কালেও যোগ দেন নানা শিল্পযজ্ঞে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার যুক্ত হন মনোভুমি আর্ট স্পেস আয়োজিত আর্ট ক্যাম্পের সঙ্গে। এ প্রদর্শনীর সঙ্গে নিজের কাজের সম্পর্ক ও চার দিনের ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলেন শিল্পী রা কাজল- ‘ক্যাম্পের শুরুটা হেসে খেলেই কাটছিল। বলা যায় অনেকটা আড্ডার মধ্য দিয়ে একে অপরের সাথে চিন্তার আদান প্রদান ঘটছিল। যেটা আর্ট ক্যাম্পেরই একটা অংশ। শেষ পর্যায়ে এসে সবাই কাজে সিরিয়াস হই। বাংলাদেশে ক্যাম্পটা ইদানিং বেশ প্রচলিত। এটি বেশ ভালো উদ্দ্যগ বলতে হবে। এতে আর্টিস্টদের মধ্যে সংযুক্তি ঘটে, চিন্তার আদান-প্রদান হয়। আবার যারা পেশাগত কারনে ছবি আঁকা থেকে একটু দূরে আছেন তারা এ কদিন কাজে মধ্যে পুরোপুরি নিয়োজিত থাকতে পারেন। এটি আর্ট ক্যাম্পের একটি সফল দিক বলতে হবে।
ওয়াটার কালার আমার মাধ্যম না। তাই সচরাচর এ মাধ্যমে কাজ করা হয় না। কিন্তু এই ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা নিয়ে মনে হচ্ছে এটা নিয়ে সিরিজ করা যায়। ওয়াটার বেইজ কালার নিয়ে ব্যতিক্রম ধারার এ ক্যাম্পে সবার কাজেই আউটপুট বেশ চমৎকার এসেছে। এই হরতাল অবরোধের মধ্যে প্রতিদিনই প্রচুর লোক সমাগম থেকেই বলা যায় এটি একটি সফল প্রদর্শনী।
‘People Carring Bamboo’ শিরোনামের কাজ দুটো আমার আগের সিরিজ কাজের অংশ। এ কাজের কনস্পেটটা এরকম, এখানে অনেকগুলো ফিগার দেখা যাচ্ছে। প্রতিটির মাথা রোবটের মত একই রকম, বৈচিত্রহীন। মানে মানুষ তার নিজস্বতা হারাচ্ছে। আলাদা করে আর ভাবতে পারছেনা। আগে একেক অঞ্চলের লোক আলাদা আলাদা সংস্কৃতির চর্চা করতো। কিন্তু এখন ডিজিটাল কারণে সব অঞ্চলের লোকের ভাবনার জায়গাটা এক হয়ে গেছে। মানুষ একটা গন্ডির মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলছে। এতে মানুষ তার মৌলিকতা হারাচ্ছে। আর বাকি দুটো খুবই সিম্পল, ফ্যান্টাসি থেকে করা। একটি ‘Angel of Love’ বা ‘প্রেমপরি’ আর অন্যটি ‘King of Love’ বা ‘প্রেমরাজ’।’
প্রদর্শনী ও ব্যক্তিগত কাজ নিয়ে আলোচনা করেন শিল্পী রসিদ আমিন- ‘এটি নিরীক্ষাধর্মী প্রদর্শনী। জলরঙ বলতে আমরা গতানুগতিক ভাবে বুঝি নদী নৌকা, ল্যান্ডস্কেপ প্রভৃতি। বর্তমানে জলরঙ মাধ্যমে নানামুখি সম্ভাবনা তৈরী হচ্ছে। আগের চাইতে এখন অনেক বেশি নিরীক্ষাধর্মী কাজ করা হচ্ছে।
জলরঙে আগেও অনেক এক্সপ্রিমেন্ট কাজ করেছি। রঙ গড়িয়ে পরা, রঙের সাথে রঙ মিশে যাওয়া অনেকটা রঙ নিয়ে খেলা করা। একটা বিমূর্তভাব তৈরী করার চেষ্টা থাকে সবসময়।। তারই ধারাবাহিকতায় এ প্রদর্শনী। এই কাজগুলোতেও রঙ নিয়ে খেলা করেছি। মূলত প্রকৃতিই আমাকে সহযোগীতা করে। প্রকৃতি আমার কাজের প্রতিপাদ্য বিষয়। অনেক দিনের দেখা প্রকৃতির একটা প্রতিচ্ছবি, আমার কাজে বিমূর্তভাবে রঙ, রেখা ও ফর্মের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছি। যেটা নাম দিয়েছি ‘Maindscape’ বা ‘মনছবি’।’
শিল্পী শহীদ আহমেদ মিঠু ‘Poetry of Water’ অর্থাৎ ‘জলের কাব্য’ শিরোনামে দক্ষ্য হাতে চিন্তার বহি:প্রকাশ ঘটান। তার প্রতিটি ছবি সত্যি অর্থেই এক একটি কাব্য।
সোহেল প্রানণের কাজের শিরোনাম, ‘Portrait’ বা ‘প্রতিকৃতি’। তিনি জলরঙে ভিন্ন ধারায় প্রতিকৃতি অঙ্কন করেন।
ইসরাত জাহান কাকন ‘Light of Dream’ যার অর্থ ‘স্বপ্নের আলো’ শিরোনামে জলরঙ মাধ্যমে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ চারটি কাজ প্রদর্শন করেন।
মাসুদুর রহমান ‘Time Vortex’ অর্থাৎ ‘সময়ের আবর্ত’ শিরোনামের কাজে নানাভাবে জলরঙে, ভিন্নমাত্রা তৈরী করেন।
জাহিদ হোসেনের কাজের শিরোনাম ‘Color of Life’ বা ‘জীবনের রঙ’। এ কাজগুলোতে জলরঙের যথার্ত প্রয়োগ করেন তিনি।
No Comments