। রিদওয়ান আক্রাম ।
ঢাকা, রাজধানী হওয়ার পর থেকে সবার সামনে চলে আসে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কারণে গুরুত্ব বেড়ে যায় ঢাকার। তবে রাজধানী পরিবর্তন হওয়ার কারণে এটির গুরুত্ব কমে গেলেও এর একটা নস্টালজিক রোম্যান্টিকতা দাঁড়িয়ে যায়। আর সে রোম্যান্টিকতায় আক্রান্ত হয় এ শহরে আসা ইউরোপীয় ভ্রমণকারীরা, যাদের আবার একটা বড় অংশই ছিল শিল্পী। কেই বা পেশাদার আর কেউ বা অপেশাদার। তাদের চিত্রকলায় ঢাকা ধরা দিয়েছে বিভিন্ন আঙ্গিকে, বিভিন্ন মাত্রায়। শুধু কি ভ্রমণকারী? যাঁরা কর্মসূত্রে এ শহরে বসবাস করেছেন তাঁরাও অক্লান্তভাবে ঢাকার ছবি একেঁছেন। আর কর্মস্থল ত্যাগ করার ফলে সেসব চিত্রকলা নিজেদের সঙ্গে নিয়েও গিয়েছেন। আর তাই তো ঢাকার পুরোনো চিত্রকলা বলতে গেলে একরকম হাতে গোনা। পরবর্তীকালে যদিও ঢাকার বেশ কিছু চিত্রকলা কিছু হদিস পাওয়া গেছে, তবে সে সংখ্যাটা খুবই কম।
দ্য গ্রাফিক
এই ইলাসট্রেইড পত্রিকাটির যাত্রা শুরু হয় ১৮৬৯ সালের ৪ ডিসেম্বর। এটির প্রকাশক ছিল ইলাসট্রেইড নিউজপেপার লিমিটেড। ‘দ্য গ্রাফিক’ যে ইংল্যান্ডের প্রথম কোনো ইলাসট্রেইড পত্রিকা ছিল, তা কিন্তু নয়। এরও আগে যাত্রা শুরু করেছিল আরেকটি ইলাসট্রেইড পত্রিকা ‘ইলাসট্রেইড লন্ডন নিউজ’। ১৮৪২ সালে স্থাপিত পত্রিকাটি সে সময়ে ছিল দারুণ জনপ্রিয়। মূলত সে পত্রিকাটির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতেই দ্য গ্রাফিকের জন্ম। বেশ ঝুঁকি নিয়েই দ্য গ্রাফিক তার যাত্রাটি শুরু করেছিল। কেননা এর আগে ‘ইলাসট্রেইড লন্ডন নিউজ’-এর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বন্ধই হয়ে গিয়েছিল ‘ইলাসট্রেইড টাইমস’ এবং ‘পিক্টোরিয়াল টাইমস’-এর মতো ইলাসট্রেইড পত্রিকাগুলো। তবে দ্য গ্রাফিককে সে অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়নি। পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম লুসন টমাস বেশ কিছু প্রতিভাবান শিল্পীকে একত্র করতে পেরেছিলেন। তাঁদের বদৌলতে অল্প সময়ের মধ্যে দ্য গ্রাফিক দাঁড়িয়ে যায়। এবং একসময় হয়ে ওঠে ‘ইলাসট্রেইড লন্ডন নিউজ’-এর কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী।
প্রথম দিকে এটি সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হতো প্রতি শনিবার। ২৪ পৃষ্ঠার পত্রিকাটির মূল্য ধরা হয়েছিল ছয় পেন্স। এটির গ্রাহক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল তখনকার সারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং উত্তর আমেরিকায়। ফৌলিউ (বড়ো এক খণ্ড কাগজ এক ভাঁজ করে তৈরি দুই পাতা বা চার পৃষ্ঠা) আকারের পত্রিকায় থাকত দেশ-বিদেশের খবর, গির্জার সংবাদ, সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা ব্রিটিশ উপনিবেশের খবরাখবর। আর নিয়মিত সংবাদের মধ্যে থাকত খেলাধুলা, সংগীত, বিজ্ঞান, বই সমালোচনা এবং সারা সপ্তাহের সারসংক্ষেপ। মোদ্দা কথায় আধুনিক পত্রিকার সেকালের সংস্করণ বলা যেতে পারে দ্য গ্রাফিককে। ভাড়া করা বাসায় শুরু হলেও ১৩ বছরের মাথায় দেখা যায়, পত্রিকাটির মালিকানায় রয়েছে তিন তিনটে বাড়ি, ২০টি ছাপাখানা আর এক হাজারেরও বেশি কর্মচারী। বোঝাই যাচ্ছে বেশ জমে উঠেছিল দ্য গ্রাফিকের ব্যবসা। ১৯৩২ সালের ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত পত্রিকাটি দ্য গ্রাফিক নামেই চালিয়ে গিয়েছিল প্রকাশনা।
ইলাসট্রেইড পত্রিকার মূল আকর্ষণ ছিল এর ছবি। আর একসময় পর্যন্ত এসব ছবির একটা বড় অংশই ছিল চিত্রকলা। পরে অবশ্য ক্যামেরার প্রচলন হলে এসব পত্রিকায় শুরু হয় আলোকচিত্রের ব্যবহার। তবে ছবি ব্যবহার করা হতো ইনগ্রেইড বা কাঠ খোদাইয়ের ছাপের মাধ্যমে।
আগেই বলা হয়েছে, দ্য গ্রাফিকে সারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সংবাদ পাওয়া যেত। সে ধারাবাহিকতায় ‘ঢাকা’ও স্থান পেয়েছিল পত্রিকাটিতে। এটির যে পাতাটি পাওয়া গেছে, তাতে স্থান পেয়েছে তখনকার ঢাকার বিশেষ দ্রষ্টব্যগুলো। এসবের মূল একটি শিরোনাম ‘বাংলার ঢাকা শহরের প্রাচীন দালানসমূহের স্কেচ’ থাকলেও প্রতিটির সঙ্গে আছে আলাদা শিরোনাম, ‘নবাববাড়ির ধ্বংসাবশেষ’, ‘প্রাচীন দুর্গের ধ্বংসপ্রাপ্ত তোরণ’, ‘সাত মসজিদ কিংবা সাতগম্বুজ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ’ এবং ‘ধ্বংসপ্রাপ্ত তোরণ’। পুরো পাতাজুড়ে থাকা ছবিগুলোর আকার ছিল ১৫.৫ বাই ১১ ইঞ্চি (৩৯৫ বাই ২৮০)। আর ছবিগুলোর শিরোনাম কিছুটা দ্বিধায় ফেলতে পারে। কেননা ছবি অনুযায়ী শিরোনামগুলোয় খানিকটা ভুলভ্রান্তি আছে। তার আগে বলে নেওয়া ভালো, ছবিগুলোর প্রকাশকাল ১৮৭৪ সাল। তবে এটা ধরে নেওয়াটা ভুল হবে, ছবিগুলো আঁকার সময়কাল আর প্রকাশকাল এক। কেননা দ্য গ্রাফিকের শিল্পীর এত দূরে গিয়ে ছবি আঁকতেন না। প্রতি সপ্তাহের ২৪ পাতার পত্রিকার জন্য বিশাল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কোনায় কোনায় গিয়ে ছবি আঁকাটা একরকম অসাধ্য এক কাজ ছিল বৈকি। তবে একদমই যে হতো না, তা কিন্তু নয়। সেটা উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। তাহলে কীভাবে দ্য গ্রাফিকের ছবিগুলোর ইনগ্রেইভিং করা হতো? সম্ভাব্য উত্তরটি হতে পারে পত্রিকাটি সংশ্লিষ্ট ছবিগুলো সংগ্রহ করে নিত। হতে পারে মূল ছবিগুলো কিনে কিংবা ধার করে কাজ চালানো হতো। এতে প্রামাণ্য ছবিগুলো সংগ্রহ করা যেত। অনেক সময় এসব ছবি ১০ থেকে ১৫ বছর পুরোনো হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।
প্রাচীন দুর্গের ধ্বংসপ্রাপ্ত তোরণ
সম্পাদক মহোদয় সম্ভবত ভুল শিরোনাম বসিয়েছিলেন কিংবা তাঁর পাওয়া তথ্যে গলদ ছিল । ছবি থেকে স্পষ্টত বোঝা যায়; এটি বড় কাটরার প্রবেশপথ। হয়তো লালবাগ কেল্লার জন্য লেখা শিরোনামটি ভুল করে বড় কাটরার প্রবেশপথে বসানো হয়েছে। তা ছাড়া এ ছবিটি ইনগ্রেইড করা হয়েছে ১৮৬৩ সালে জলরঙে আঁকা ফ্রিডারিক উইলিয়াম অ্যালেকন্ডার ডি ফেব্যাকের ছবি থেকে।
নবাববাড়ির ধ্বংসাবশেষ
এটিও মূলত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকুরে ফ্রিডেরিক উইলিয়াম আলেকজান্ডার ডি ফাবেকের আঁকা ছবিরই আরেকটি রূপ।
সাত মসজিদ কিংবা সাত গম্বুজ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ
শিরোনামই বলে দিচ্ছে এই ছবির শিরোনামদানকারী স্থাপনাটি ‘মসজিদ’ নাকি ‘মন্দির’, তা নিয়ে ছিলেন বেশ সন্দিহান। তবে বুঝে নিতে কষ্ট হয় না, এটা মোহাম্মদপুরের ‘সাত গম্বুজ মসজিদ’। সুবাদার শায়েস্তা খাঁর দ্বিতীয় সুবাদারির সময় (১৬৭৯-৮৮ সাল) এটি নির্মিত হয়েছিল। ছবি দেখে মনে হচ্ছে, মসজিদটি লোকালয় থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।
ধ্বংসপ্রাপ্ত তোরণ
লালবাগ কেল্লার তোরণ এটি। ছবিতে দুর্গটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মনে হচ্ছে। লতাপাতা বেশ ভালোভাবে গ্রাস করেছিল মোগলদের এই দুর্গটিকে।
গুরু-শিষ্যের ঢাকা
এখন পর্যন্ত ঢাকার প্রাচীনতম চিত্রের কথা চলে আসবে স্যার চার্লস ড’য়লির আঁকা ছবির ফৌলিউ ‘অ্যান্টিকুইটিজ অব ঢাকা’। আজ থেকে দুই শ বছর আগে আঁকা এই ইংরেজ শিল্পীর ছবির সঙ্গে আজকের আধুনিক ঢাকা শহরকে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু শিল্পীর চিত্রিত ইতিহাস আমাদের বলে দেয় অতীতের কথা; অতীতে ঢাকার কথা। ১৮০৮ সালের ১১ মে ঢাকায় পা রাখেন চার্লস ড’য়লি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকুরে হিসেবে এ শহরে তাঁর পদার্পণ। ছোটখাটো কোনো চাকুরে নয়; একেবারে ঢাকার কালেক্টর। তিন বছর দায়িত্ব পালন করেন একই পদে থেকে। উনিশ শতকের প্রথম দশকে পূর্ববঙ্গের অন্য আট-দশটা মফস্বল শহরের থেকে আলাদা কিছু ছিল না ঢাকা। শহরে ইউরোপীয়দের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা কয়েকজন (১২ জন)। ঢাকায় থাকাকালীন এদের ভুগতে হতো একাকিত্বে। ড’য়লিও এর বাইরে ছিলেন না। ফলে তিনি ঝুঁকে পড়ে আঁকাআঁকির প্রতি। তাঁর জন্য বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সে সময়কার ঢাকার পড়তি সময়টাকে। আর তাই তো ছবিতে একধরনের নস্টালজিক আবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। ঢাকায় থাকাকালীন ড’য়লি ছবি আঁকায় তেমন একটা দক্ষতা অর্জন করেনি। এ শহরে আসার আগে তিনি আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছিলেন পেশাদার আইরিশ শিল্পী জর্জ চিনারিকে ঢাকায় আসার জন্য। চিনারি সে আমন্ত্রণ রক্ষা করেন। ড’য়লি ঢাকায় একটু থিতু হয়ে বসার তিন মাসের মাথায় হাজির হলেন চিনারি। উঠলেন বন্ধুর বাড়িতেই। সেখানে নিজের আঁকা তো চলছিলই, পাশাপাশি চলছিল ড’য়লিকে ছবি আঁকার শিক্ষাদান। একসময় গুরু-শিষ্য মিলে ঢাকার বেশ কিছু ছবিও এঁকে ফেললেন। ড’য়লি পেশাগত কারণে ঢাকা ত্যাগ করতে পারলেও চিনারির ছিল না সে বাধ্যবাধকতা। তিনি একাই ঘুরে বেড়ালেন পূর্ব বাংলা। গিয়েছেন কুমিল্লা, ত্রিপুরা, বরিশালসহ অন্যান্য অঞ্চলে। এই জন্য বাংলার গ্রামীণ পরিবেশের বেশ কিছু স্কেচও তাঁর দেখা যায়। প্রায় তিন বছর ঢাকায় থাকার সময় পূর্ব বাংলা এবং ঢাকার বেশ কিছু ছবি এঁকেছিলেন। সেসব ছবির কিছু ড’য়লি তাঁর ‘অ্যান্টিকুইটিজ অব ঢাকা’তে ব্যবহার করেছেন। এ যেন শিষ্যের ‘গুরু দক্ষিণা’।
কুঁড়েঘরসংবলিত এক মসজিদের ধ্বংসাবশেষ
‘অ্যান্টিকুইটিজ অব ঢাকা’তে স্থান পাওয়া চিনারির চারটি ভিনিয়েটের (বইয়ের নামপত্রে কিংবা অধ্যায়ের শুরুতে বা শেষে অলংকরণমূলক নকশা) সঙ্গে এটির ধরন মিলে যায়। তা ছাড়া ‘অ্যান্টিকুইটিজ অব ঢাকা’র বেশির ভাগ ছবি কোনো না কোনো মোগল স্থাপনাকে কেন্দ্র করে আঁকা এবং সেগুলো ঢাকা ও শহরের আশপাশে এলাকার আঁকা। সে হিসেবে বলা যেতে পারে; ১৮১০ সালে আঁকা এই তৈলচিত্র ঢাকা এবং এর আশপাশের এলাকার হওয়া সম্ভাবনাই বেশি।
এক সমাধির দৃশ্য
ঢাকায় থাকার সময় ড’য়লি তাঁর শিক্ষক চিনারির সঙ্গে পূর্ববঙ্গের কোথাও ঘুরতে গিয়েছিলেন; এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ১৮০৮ সালের ১১ নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় কালেক্টর হিসেবে অস্থায়ী দায়িত্ব পালন করেছিলেন শ্যারম্যান বার্ড। হতে পারে এ সময় ড’য়লি ছুটি কাটাচ্ছিলেন। এ সময়টার মধ্যে ‘এক সমাধির দৃশ্য’ ছবিটি আঁকা নয়; কেননা এটি আঁকা হয়েছে ১৮১০ সালে। সে সময় ড’য়লি ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও যাননি। অতএব ধরে নেওয়া যায়; ছবিটি ঢাকা কিংবা ঢাকার আশপাশেই কোথাও আঁকা হয়েছে।
পাগলাপুলের ধ্বংসাবশেষ
এ ছবিটির সঙ্গে মিল পাওয়া যায় ‘অ্যান্টিকুইটিজ অব ঢাকা’তে স্থান পাওয়া পাগলাপুলের ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে। দুটি ছবি আছে সে ফোলিওতে। একটির শিরোনাম ‘পাগলাপুল থেকে দূরে ঢাকার কিছু অংশ’ এবং অন্যটি ‘পাগলাপুল; নদীর দিক থেকে’। ড’য়লির আঁকা পাগলাপুলের সে দুটি ছবির সঙ্গে আমাদের এ ছবির পুলের নকশা; সমানুপাতিকতায় মিল খুঁজে পাওয়া যায়। শুধু তা-ই নয়, মিল রয়েছে আঁকার ধরনেও। সব কিছু মিলিয়ে বলা যায়; এটি ড’য়লির আঁকা পাগলাপুলেরই একটি দৃশ্য।
ফিলিপসের ঢাকা
জোসেফ স্কট ফিলিপস ছিলেন দমদমের অতিরিক্ত সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট। ভদ্রলোক ১৮৩৩ সালে ঢাকায় হাজির হন। ছিলেন এক মাসের মতো। ঠিক কী উদ্দেশ্যে তিনি এখানে এসেছিলেন, সে সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। তবে তিনি যাত্রাপথে আসতে আসতে যেসব ছবি এঁকেছেন; সেসব ছবি আঁকার সময়কাল দেখলে মনে হয় ভদ্রলোক পূর্ববঙ্গ ভ্রমণেই বেরিয়েছিলেন। খানিকটা সময় নিয়ে সুন্দরবন থেকে ১৮৩৩ সালের ২১ মার্চ রওনা হন ঢাকার উদ্দেশে। বরিশাল হয়ে এপ্রিলের একদম প্রথম দিকে হাজির হন ঢাকায়। এই যাত্রাপথে যা কিছু নিজের কাছে কৌতূহলোদ্দীপ মনে হয়েছে, সেসবের ছবির তিনি এঁকেছেন। এসব ছবির ৪৬টি নিয়ে আলাদা একটি ফৌলিউ করা হয়। এতে ঢাকাসম্পর্কিত ছবির মধ্যে আছে; ‘মুসলমান সমাধি। ডা. ল্যাম্বের বাগানে মসজিদ’ (পেন্সিল স্কেচ), ‘ঢাকার কাছে মথ (নাকি মঠ)’ (পেনসিল স্কেচ), ‘ঢাকা, শ্যামপুর পুল’ (পেনসিল স্কেচ), ‘ঢাকা থেকে ১০০ মাইল দূরে লাক্ষ্য নদীর তীরে ভিড়ানো নৌকা’ (পেননিল স্কেচ), ‘হোটেল ফর ডা. ল্যাম্বস, ঢাকা’ (পেনসিল স্কেল) ‘মন্দির এবং কুঁড়েঘর’ (জল রং), ‘ঢাকার ২৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে রাজনগরে হিন্দু মন্দির’, ‘রাজনগরে হিন্দু দালান’। আর এসব ছবি তিনি এঁকেছেন ‘ইউরোপীয় স্কুল’ এবং ‘ব্রিটিশ স্কুল’ অঙ্কনরীতিতে।
এসবের মধ্যে ‘মন্দির এবং কুঁড়েঘর’ (রমনার কালীবাড়ি) শিরোনামের ছবি এর আগেও আমরা দেখেছি।
ঢাকার ২৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে রাজনগরে হিন্দু মন্দির
এটি ফৌলিউয়ের ১৮ নম্বর ছবি। ২৮ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য এবং ২৭ দশমিক ১ সেন্টিমিটার প্রস্থের এ ছবি আঁকা হয়েছে ৩০ এপ্রিল। মন্দিরের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন ফিলিপস; ‘একটা কামরায় সাধারণ যে পরিমাণ খোলা জায়গা থাকে, এটিতে বলতে গেলে সে রকম কিছু নেই। আর অন্যভাবে বলে এটা অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে প্যাসেজ এবং বাদুরভর্তি কক্ষ ছাড়া আর কিছুই নয়। মাঝেমধ্যে এতে বাস করে নোংরা সব ফকির।’
রাজনগরে হিন্দু দালান
১১টি সুউচ্চ চূড়াবিশিষ্ট এই মন্দিরটি ফিলিপসের ফৌলিউয়ের ১৯ নম্বর ছবি। ১৮ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য এবং ২৭ দশমিক ১ সেন্টিমিটার প্রস্থের এ ছবিটি আঁকা হয়েছে ৩ মে। মন্দিরটিকে শিল্পী বিশাল কোনো হিন্দু দালান হিসেবে মনে করেছিলেন। কষ্ট করে ফিলিপস এটি এঁকেছিলেন। নির্ভুলভাবে আঁকার জন্য ভরদুপুরে গরম আবহাওয়ার মধ্যে তাঁকে কাজ করতে হয়েছে।
ফাবেক ভাইদের ঢাকা
ফাবেকরা ছিলেন দুই ভাই। দুইজনেই ছিলেন ‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসেস’-এর চাকুরে। বড় ভাই ফ্রিডেরিক উইলিয়াম আলেকজান্ডার ডি ফাবেক জন্মগ্রহণ করেছিলেন ইংল্যান্ডে, ১৮৩০ সালে। তবে পড়াশোনা করেছেন প্যারিস শহরে। পরে অবশ্য ইডেনবারার ‘দ্য রয়েল কলেজ অব সার্জনস’ থেকে বৃত্তিপ্রাপ্ত হন। বোঝা যাচ্ছে, বেশ মেধাবী ছিলেন বড় ফাবেক ভাইটি। আর তাই পড়াশোনার পাট চুকে গেলে চাকরি পেতে তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি। ১৮৫৮ সালে পেয়ে যান বেঙ্গল সার্ভিসে সহকারী সার্জনের পদটি। মারা যান ইতালিতে। ১৯১২ সালে। আর অন্যদিকে ছোট ভাই উইলিয়াম ফ্রিডেরিক ডি ফাবেকের জন্ম ১৮৩৪ সালে। বয়সে ছোট হলেও উইলিয়াম মাদ্রাজ সার্ভিসের চাকরি জুটিয়ে নেন বড় ভাইয়ের এক বছর আগেই; ১৮৫৭ সালে। এরপর সার্জন হন ১৮৬৯ সালে, সার্জন মেজর ১৮৭৪ সালে এবং ব্রিগেড সার্জন ১৮৮২ সালে। সে সময় ভারতবর্ষের ইউরোপীয় কর্মচারীদের মধ্যে আঁকাআঁকিটা ছিল সাধারণ এক বিষয়। চিত্রকলায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসব কর্মচারী আঁকতে পারতেন। তবে কারো কারো মধ্যে সে দক্ষতাটা থাকত বিশেষ মাত্রায়। উইলিয়াম ফ্রিডেরিকের ক্ষেত্রেও তেমনটা ঘটেছে। পরে তিনি ভারতের জয়পুরের ‘দ্য স্কুল অব আর্ট’-এর শিক্ষকও হয়েছিলেন। পরে অবশ্য সে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকও হয়েছিলেন উইলিয়াম। ১৮৮৩ সালে জয়পুরে একটি চিত্রকলা প্রদর্শনীরও আয়োজন করেছিলেন তিনি। মারা যান লন্ডনে, ১৯০৬ সালে।
সংক্ষেপে এই হলো ফাবেক ভাইদের ঠিকুজি। তাঁদের সম্পর্কে এত সব কথা বলার মূল কারণ হচ্ছে, এঁদের একজন এঁকেছিলেন ঢাকার ছবি। আমাদের সংগ্রহে আসা ছয়টি ছবিই বড় ভাই ফ্রিডেরিক উইলিয়ামের আঁকা। জলরঙে আঁকা ছবিগুলোর সময়কাল ২২ মে, ১৮৬১ থেকে ১৮৬৩ সাল পর্যন্ত। এই সময়টায় কি ভদ্রলোক ঢাকা ভ্রমণে এসেছিলেন, নাকি চাকরি সূত্রে বসবাস করতেন, তা নিশ্চিত নয়। তবে তাঁর আঁকা ছবি দেখে ধারণা করা যেতে পারে, বেশ সময় নিয়েই ছবিগুলো এঁকেছেন ফ্রিডেরিক।
ঢাকায় মসজিদের ধ্বংসাবশেষ (১৮৬৩)
শিল্পী মসজিদটির নাম উল্লেখ করেননি। তবে ছবি দেখে নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে, এটি লালবাগের আতিশখানা এলাকার খান মুহম্মদ মিরধার মসজিদ। ঢাকায় মোগল আমলে তৈরি বেশ কয়েকটি ভল্টের উর্দু ভূমি বা তহখানার ওপর মসজিদ আছে। এই মসজিদে ওঠার জন্য থাকে সিঁড়ি। এই সিঁড়ি পথের সূত্র ধরে বলা যায়, ছবির মসজিদটির সঙ্গে খান মুহম্মদ মিরধার মসজিদের হুবহু মিল রয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠে গেলে মসজিদের বাইরে অংশে পা দিতেই পড়বে একটি সুদৃশ্য তোরণ। ফ্রিডেরিকের আঁকায় তোরণের দুটি ক্ষুদ্রাকৃতির চূড়ার অস্তিত্ব লক্ষ করা গেলেও বর্তমানে এই চূড়াগুলোর কোনো অস্তিত্বই নেই।
মসজিদটি ১৭০৭ সালে ঢাকায় কাজী এবাদুল্লাহর উপদেশে কিংবা আদেশে নির্মাণ করেন খান মুহম্মদ মৃর্ধা।
ঢাকার একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রবেশপথ
এ ছবিটি আঁকার সময়কাল ১৮৬৩ সালের ফেব্রুয়ারি। ছবির শিরোনাম ‘ঢাকার একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রবেশপথ’ হলেও এটির নিচের দিকে বাঁয়ে লেখা আছে: ‘ঢাকার নবাববাড়ির প্রবেশ’। ছবিটি যখন আঁকা হয় তখন ঢাকার নবাব বলতে নায়েব-নাজিমদেরই বোঝানো হয়। আহসান মঞ্জিলেই নবাবরা তখনো ইংরেজদের থেকে ‘নবাব’ উপাধি পাননি। এ হিসাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে এই প্রবেশপথ নিমতলী প্রাসাদের কোনো প্রবেশপথ হবে।
ঢাকার ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রবেশপথ (১৮৬৩)
বড় কাটরার দক্ষিণ দিকে প্রবেশের পথের ছবি। ছবি দেখে বোঝা যায়, তখনই বড় কাটরাসংলগ্ন এলাকায় দখল প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। বাঁয়ে কুঁড়েঘর আবার ডান দিকে দালান ঢাকার তৎকালীন অবস্থাকে সামনে নিয়ে আসে। কর্দমাক্ত রাস্তায় চলছে মালবাহী গরুর গাড়ি। সব জায়গায় স্পষ্ট দৈন্যের ছাপ।
বুড়িগঙ্গা থেকে ঢাকা শহরের দৃশ্য (১৮৬১)
চমৎকার কাজ করেছেন শিল্পী এ ছবিটিতে। বোঝাই যাচ্ছে, বেশ সময় নিয়ে নদীর দিক থেকে ঢাকাকে নিজের ছবিতে ধরার চেষ্টা করেছেন। ছবি দেখে মনে হয়, নদীর পাড় তখনো ঘিঞ্জি হওয়া শুরু করেনি। পয়সাঅলা লোকদের বাসস্থান হিসেবে বুড়িগঙ্গার পাড়টি এক রকম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নই ছিল। নদীর পাড় ঘেঁষে বিভিন্ন ধরনের নৌকা এবং লোকজনের কর্মকাণ্ড বেশ কৌতূহলোদ্দীপক বৈকি!
নবাববাড়ির ধ্বংসাবশেষ (১৮৬৩)
‘নবাববাড়ি’। কিন্তু ছবির ‘নবাববাড়ি’টি কোনটি? ঢাকার নবাব বলতে এখন আমরা যাদের বুঝি, সেই ‘আহসান মঞ্জিল’-এর নবাবদের বাড়ি এটি নয়। কেননা তাদের বংশানুক্রমিকভাবে ‘নবাব’ উপাধি ব্যবহার করার অনুমতি ইংরেজরা দেয় ১৮৭৫ সালে। আর এই ছবিটি আঁকা হয়েছে ১৮৬৩ সালে। সে হিসেবে বলা যেতে পারে, ছবির এই নবাববাড়ি হচ্ছে ‘নিমতলী প্রাসাদ’ বা ঢাকার নায়েব-নাজিমদের বাসস্থান। ঢাকার নায়েব-নাজিমরা স্থানীয়ভাবে পরিচিত ছিলেন নবাব হিসেবে। এঁরাই ছিলেন মোগলদের সঙ্গে ঢাকার শেষ যোগসূত্র। ঢাকার শেষ নায়েব নাজিম বা নবাব গাজীউদ্দিন মারা যান ১৮৪৩ সালে। তাঁর মৃত্যুর পর নবাব পরিবার বিলুপ্ত হলেও সম্ভবত এই বাড়িতে নবাবের নিকটাত্মীয়রা থাকতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ প্রাসাদ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অল্প কিছু মাসোহারাও দিত। বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য ছয় রক্ষীকে দেওয়া হতো ১৮ টাকা। তবে অল্প কিছুদিন পরই কোম্পানি প্রাসাদটি নিলামে তুলে বিক্রি করে দেয়। বিভিন্ন ক্রেতা সেটি কিনে ভেঙে ফেলে। এটা যদি শেষ পর্যন্ত নিমতলী প্রাসাদের অংশ হয়ে থাকে; তাহলে বলতে হবে এই ছবিটিই নিমতলী প্রাসাদের অভ্যন্তরের দিক দেখতে পাওয়া প্রামাণ্য কোনো ছবি।
লালবাগ কেল্লা (১৮৬১ থেকে ১৮৬৩ সালের মধ্যে)
আগের ছবিগুলোর মতো এটাও জলরঙেই আঁকা। তবে এটার কাজ তেমন একটা ‘ডিটেল’ নয়। ছবিতে যেহেতু শিল্পীর স্বাক্ষর রয়েছে বলা তিনি সচেতনভাবেই ছবিটি এভাবে এঁকেছেন। ছবিতে লালবাগ কেল্লার ভেতরের অংশ দেখা যাচ্ছে। এটির কেন্দ্রবিন্দুতে আছে কেল্লার মসজিদ আর বিবি মরিয়মের মাজার। তবে দূরে কেল্লার প্রাচীরও দেখা যাচ্ছে।
হেনরি ব্রিজেস মোলসওয়ার্থ
ইনি পেশাদার কোনো শিল্পী নন। জন্ম ইংল্যান্ডের উলউইচে ১৮৫৫ সালের ৭ জুলাই। আর মৃত্য ১৯৫৪ সালে। পড়াশোনা করেছেন উইন্ডারমারে কলেজে। এখানে পড়ালেখার পর যোগ দেন রয়েল নেভিতে ১৮৬৯ সালে। তিনি কাজ শুরু করেন ‘এইচ.এম.এস. ব্রিটানিকা’ জাহাজের একজন ‘নেভাল ক্যাডেট’ হিসেবে। ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি নৌবাহিনীতে থাকেন। ওই বছরের নভেম্বর মাসে যোগ দেন ব্রিটিশ ভারতের ‘পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টে’, একজন সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে। প্রথমে তিনি গণপূর্ত অধীনে ‘নর্দান বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে’ এবং পরে দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধের (১৮৭৮-১৮৮০ সাল) সময় ‘ঝিলাম-পিন্ডি স্টেট রেলওয়ে’-এতে বদলি হন। পরে বেঙ্গল স্টেট রেলওয়েতে ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পদোন্নতি পান ও পর্যায়ক্রমে একই পদে নিজামের স্টেট রেলওয়েতে যোগ দেন। প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন এবং রেললাইন স্থাপনের জন্য জরিপ এবং নির্মাণকাজের জন্য তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। এ সময় তিনি নিজের কর্মস্থলের বেশ কিছু ছবি একেঁছিলেন নিজের মনের খোরাক মিটানোর জন্য। জলরঙে আঁকা এইসব ছবির মধ্যে আছে ঢাকার চাঁদনী চকের ‘ওয়াটার ওয়ার্কস’, ফুলবাড়িয়া, সাভার, বাইগুনবাড়ি, মিরপুর, কেরানীগঞ্জ, তুরাগ, শ্রীপুর, টঙ্গী পুল, গোড়ান প্রভৃতি। এই সব ছবি সম্ভবত ১৮৮০ সালে পরে বা সমসাময়িক সময়ে আঁকা হতে পারে।
এখানে স্থান পেয়েছে তিনটি ছবি। এগুলো হচ্ছে: পশুপাখির হাত থেকে রক্ষার জন্য প্রহরীদের ঘর, বাইগুনবাড়ি, সাভার; মিরপুরে মিচেল সাহেবের বাড়ি এবং মিরপুরে অস্থায়ী পুলের নির্মাণ।
No Comments