[metaslider id=57]
।প্রভাষ আমিন।
ধ্রুব এষকে আমি চিনি কম করে ২৫ বছর। নব্বই দশকের সেই উত্তাল সময়ে ধ্রুব এষকে চিনতো না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এমন লোক খুব কম। ধ্রুব এষ যেন একটা ব্র্যান্ড- শিল্পীদের মানুষ যেভাবে কল্পনা করে, ধ্রুব যেন তার বাস্তব রূপ। ছেড়া গেঞ্জি, ময়লা প্যান্ট, শীত-গ্রীস্ম বারো মাস পায়ে চপ্পল। আমার চেয়ে দুই বছরের বড়। কিন্তু শ্রদ্ধার, ভালোবাসার, বন্ধুত্বের সম্পর্কটা তাতে আটকায়নি। আমি তো তখন থেকেই তার ভক্ত। আমি নিশ্চিত এখনকার প্রজন্মের সবাইও তার ভক্ত। কিন্তু এখনকার প্রজন্মের অনেকেই হয়তো তাকে রাস্তায় দেখলে চিনবেনই না। ধ্রুব এখন এতই ব্যস্ত, বাসা থেকে বেরুনোর সময় নেই তার। আমি অনেক অনেক দিন পর সেদিন তাকে দেখলাম, তার নয়াপল্টনের বাসায়। চুল দাড়িতে পাক ধরা ছাড়া একটুও বদলাননি। খালি ব্যস্ততা আরো বেড়েছে।
ধ্রুব পেশাদার প্রচ্ছদশিল্পী এবং নিঃসন্দেহে তার ক্ষেত্রে সে নাম্বার ওয়ান। শুধু নাম্বার ওয়ান নয়, আসলে সে একা ও অদ্বিতীয়। বাংলাদেশে আরো অনেকেই প্রচ্ছদ করেন, তাদের অনেকে আমার প্রিয়ও। কিন্তু গুণে ও মানে ধ্রুবর কোনো তুলনা নেই। বাংলাদেশে প্রকাশনা শিল্পের সৌভাগ্য বলতে হবে, হুমায়ূন আহমেদ আর ধ্রুব এষ একই সময়ে প্রায় জুটি বেধে প্রকাশনা শিল্পকে জনপ্রিয়তা ও আধুনিকতা এনে দিয়েছেন। জনপ্রিয়তা আর আধুনিকতার এমন যুগলবন্দি সত্যি বিরল। আগে বাংলাদেশে উপন্যাসের প্রচ্ছদ মানেই একটা নারীর মুখ। হুমায়ূন-ধ্রুব জুটি এই ধারণা ভেঙ্গে দেন। হুমায়ূন আহমেদের কল্পনাকে শৈল্পিক বাস্তবতার ছোঁয়া এনে দিয়েছিলেন ধ্রুব এষ। হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুবর করা। ধ্রুবর প্রসঙ্গে একটা মজার কথা মনে পরে গেল। সম্ভবত ৯৩ সালের বইমেলা। তখন তো অন্যপ্রকাশ ছিল না। হুমায়ূন আহমেদ মেলায় এলে তার বিভিন্ন প্রকাশনীর স্টলে বসতেন। হুমায়ূন আহমেদ সবসময় পারিষদ নিয়ে চলতেন। সেই পারিষদে ঢুকে পরতাম আমিও। তো মেলায় হুমায়ূন আহমেদ বসে জমিয়ে আড্ডা মারছেন। এমন সময় বাংলা একাডেমীর নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে নতুন বইয়ের ঘোষণা দেয়া হচ্ছিল ‘… লেখক হুমায়ূন আহমেদ, প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এসো।’ শুনে খুব মজা পেলেন হুমায়ূন আহমেদ। বললেন, ‘ধ্রুব এষের নামটা তো খুব ভালো হয়েছে, ধ্রুব এসো।’ ধ্রুবও সেদিন তার বাসায় গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করলেন হুমায়ূন আহমেদকে। বললেন, ‘বাংলাদেশে প্রচ্ছদ শিল্পে আধুনিকতা আনার জন্য কেউ কেউ আমাকে কৃতিত্ব দেন। তবে এর মুল কৃতিত্ব হুমায়ূন আহমেদের। তিনি আমাকে প্রথম বলেছিলেন, আমার বইয়ের প্রচ্ছদে ফিগার আঁকতে হবে না। এই স্বাধীনতা আমাকে একলাফে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে।’
ধ্রুব এষকে দেখে আমার বিস্ময় কখনো সীমা মানে না। সাধারণত বলা হয়, সংখ্যা বাড়লে মান কমে যায়। কিন্তু ধ্রুব এই প্রতিষ্ঠিত সত্যকে মিথ্যা প্রমাণ করেছেন। ধ্রুব প্রতিবছর এত যে কাভার করেন, কিন্তু প্রতিটি কাভারই অসাধারণ। ধ্রুবর কোনো প্রচ্ছদই আমার কাছে খারাপ লাগেনি। সেদিন আড্ডায় আমি বললাম, সামনে বইমেলা, এখন তো আপনার অনেক ব্যস্ততা। মৃদু হেসে বললেন, আমার ব্যস্ততা সারা বছরের। ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখেও আমি প্রচ্ছদ আঁকি। আর আমার হিসাব ফেব্রুয়ারি টু ফেব্রুয়ারি। ধ্রুব এষ বছরে কয়টা কাভার আঁকেন? আপনাদের কারো কোনো ধারণা আছে? আমি তাকে এই প্রশ্নটি করাতে তিনি উল্টো আমাকে বললেন, বলুন তো কয়টা? আমি বোকার মত তাকিয়ে রইলাম। ধ্রুব বললেন, যখন শুরু করি, তখন ঠিক করেছিলাম বছরে ৩৬৫টা কাভার করবো। গতবছর করেছি আটশ! বিশ্বাস হয় আপনাদের? আটশ প্রচ্ছদের কোনোটিকেই আপনি বাতিল করতে পারবেন না কিন্তু। আমার তিনটি বইয়ের দুটির প্রচ্ছদ ধ্রুবর করা, দুটিই অসাধারণ। এবার আমার সহকর্মী ইশরাত জাহান উর্মির উপন্যাস ‘আবছায়া’র প্রচ্ছদ করেছেন তিনি। কথা প্রসঙ্গে উর্মির বইয়ের কয়েকটা সংশোধনীর কথা বললেন। জানালেন, ভূমিকায় নাকি আমার কথাও আছে। আমি তো শুনে অবাক, আপনি কি সব বই পড়ে প্রচ্ছদ করেন? কণ্ঠে কিছুটা কষ্ট মিশিয়ে বললেন, একসময় চেষ্টা করতাম। এখন পারি না। আর সব বই পড়ার মতও না। প্রচ্ছদ করবো বলেই অপাঠ্য বই পড়তে হবে নাকি। হতাশা প্রকাশ করলেন, গদ্যের হাল নিয়ে। ধ্রুবর মন্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রচ্ছদশিল্পী না হলে ধ্রুব কথাশিল্পী হতে পারতেন। শিশুদের জন্য চমৎকার সব লেখা আছে তার। এবার নাকি বড়দের উপন্যাস লিখছেন। আমি পড়ার জন্য গভীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি।
ব্যস্ততা নিয়ে একটু আক্ষেপ ঝরলো কণ্ঠে। বললেন, প্রতিবার বইমেলা আসে আমার কাছে বার্ষিক পরীক্ষার মত। ভাবি মেলা শেষে এটা করবো, ওটা করবো। কিন্তু কিছুই হয় না। নতুন নতুন কাজ চলে আসে। আর এত যে কাভার করেন। কিন্তু অনেকবছর মেলায় যাওয়ারই ফুরসত মেলে না। এত ব্যস্ততা যদি কখনো না থাকে? ধ্রুব তাৎক্ষণিকভাবে বললেন, তেমন দিন দুঃস্বপ্নেও দেখি না। তার মানে ব্যস্ততা নিয়ে আক্ষেপ থাকলেও ব্যস্ততাকে, কাজকে তিনি ভালোই বাসেন। ভালো না বাসলে এত কাজ করা যায় না। চোখে মুখে মুগ্ধতা নিয়ে বললেন, কাইয়ুম চৌধুরীর পূর্ণ সক্রিয় জীবন যাপনের কথা।
ধ্রুব এষ শিল্পী। কিন্তু আমার তাকে ঋষির মত মনে হয়। চলনে, বলনে ঋষির মতই। হুমায়ূন আহমেদ হিমুর চরিত্রটা কোত্থেকে নিয়েছিলেন, জানি না। হয়তো ধ্রুবকে দেখেই এঁকেছিলেন হিমুকে। হিমু তো অনেকটা ধ্রুবর মতই আলাভোলা। আবার বাড়ি সুনামগঞ্জ বলে একটা সহজাত বাউলিয়ানা আছে তার মধ্যে।
ধ্রুব এষের বাসায় যাওয়ার জন্য আমাকে উস্কাচ্ছিলেন আরেক শিল্পী বন্ধু উত্তম সেন। উত্তম দার সঙ্গে আমার এমন সব স্মৃতি আছে, উপন্যাস না লিখলে এর পুরোটা কখনোই বলা হবে না। খালি বলে রাখি, রাতের পর রাত আমি আর উত্তমদা ঢাকার রাস্তা চষে বেরিয়েছি। উত্তমদা আমাকে চিনিয়েছেন বাকুশা, টিপু সুলতান রোড, কারওয়ানবাজার কাঠপট্টি, ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে মার্কেট। খালি একটা কথা বলি, ২৩ বছর আগে আমি আর উত্তমদা যা করেছি, এখন কোটি টাকা দিলেও তা করবো না। তবে বড় আনন্দের ছিল সেই দিনগুলো, আহা বড় বেশি স্বাধীন ছিলাম আমরা। আমরা সবাই হেলাল হাফিজের একটি বইয়ের কথাই জানি ‘যে জ্বলে আগুন জ্বলে’। আমি আর উত্তমদা মিলে হেলাল হাফিজের কবিতার কার্ড ‘ভালোবেসো একশো বছর’ প্রকাশ করেছিলাম। বাংলা ১৪০০ সালে প্রকাশিত সেই কবিতার কার্ডের প্রকাশক ছিলাম আমি, প্রকশনীর নাম অনুস্বর। উত্তমদা অলঙ্করণ করেছিলেন। হেলাল হাফিজ আমার ভালোবাসাকে অনুমোদন করেছিলেন বলেই বিনা দ্বিধায় আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তার দ্বিতীয় কাব্যপ্রয়াসের পান্ডুলিপি। বিনিময় ছিল শর্তহীন ভালোবাসা আর কয়েক প্যাকেট বেনসন সিগারেট। তখন হেলাল ভাইয়ের শর্তই ছিল, তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট নিয়ে যেতে হবে। কয়েকদিন আগে তার সঙ্গে দেখা হতেই দ্রুত সিগারেট কিনতে যেতে চাইলে আটকান তিনি। বললেন, প্রভাষ, আমি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। হেলাল ভাই যদি সিগারেট খাওয়া ছাড়তে পারেন, তাহলে আমাদের উচিত সব ছেড়ে সাধু সন্নাসী হয়ে যাওয়া। বোহেমিয়ান শব্দটির মানে জানতে হলে হেলাল হাফিজকে একনজর দেখে আসলেই হবে। আগে তবু পুরানা পল্টনে একটি বাসা ছিল। এখন উঠেছেন তোপখানা রোডের এক আবাসিক হোটেলে। থাকা সেখানেই আর খাওয়া প্রেসক্লাবে। তাকে আমার শর্ত দেয়া আছে, রাতে-বিরাতে কখনো কোনো অসুবিধা হলে প্রথমে আমাকে ফোন করবেন। বাংলা ভাষার অন্যতম জনপ্রিয় কবি হেলাল হাফিজের জন্য কিছু করতে পারলে নিজের জীবন ধন্য হবে। সেই কবিতার কার্ড তুমুল জনপ্রিয় হলেও আমাদের বাউন্ডুলেপনার কারণে তা আর্থিক ক্ষতি ডেকে আনে। তাই একজন হবু প্রকাশকের মৃত্যু ঘটে। কে জানে, সেই প্রকল্প লাভজনক হলে প্রভাষ আমিন হয়তো সাংবাদিক না হয়ে প্রকাশক হয়ে যেতেন।
সেদিন ধ্রুবদার বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমি আর উত্তমদা ক্ষণিকের জন্য হলেও ফিরে গিয়েছিলাম সেই দিনগুলোতে।
স্লাইডারের ছবি: লেখক
No Comments