[if_slider id=”283″]
: প্রথম পর্ব :
এ সবই পুরোনো কথা। পুরোনোকেও নতুন করে বলা যায়; ভাবকে অবিকল রেখে ভঙ্গিটা আলাদা হলেই হয়। কিছু ঘটনা, কিছু তত্ত্ব- এর মধ্য দিয়ে আমরা পারফরম্যান্স আর্টের ইঙ্গিত চিনে নিতে পারব। মানুষ যখন নতুন কোনো ভাবের জন্ম দেয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই নিজেকে আলাদাভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করে; সেটা সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে হতে পারে; হতে পারে ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশের ক্ষেত্রেও। সমাজের আর দশজন থেকে আলাদা হওয়ার জন্য তাদের এ কৌশল নিতে হয়। ভারতে বোধিধর্ম নামে এক ঋষি ছিলেন। তিনি সত্যের ধ্যানে নয় বছর একটানা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। সে থেকে তিনি ‘দেয়াল তাকানো ব্রাহ্মণ’ বলে খ্যাতি লাভ করেছেন। আমরা আগেও দেখেছি ধর্মবেত্তারা- কেউ লাঠি হাতে, কেউ পাহাড়ের পাদদেশে, কেউ নির্জন অরণ্যে কেউ বা বোধিবৃক্ষের তলে গিয়ে ঐশিবাণী লাভ করেছেন। এসবই তাদের সে সময়ের অঙ্গীভূত ক্রিয়া বা পারফরম্যান্স আর্ট। এসব না করলে সাধারণ মানুষ তাদের প্রতি আকৃষ্ট হতো না। এভাবে নানা ভাবের সম্মিলনে তারা সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে উঠেছেন। জন্ম দিয়েছেন ধর্ম, দর্শনের।
তবে আধুনিক পারফরম্যান্স আর্টের সঙ্গে ধর্মবেত্তাদের অঙ্গীভূত ক্রিয়াকে মিলালে চলবে না; মিলানো উচিতও না। প্রশ্ন উঠতে পারে- পারফরম্যান্স আর্ট তাহলে কী। এর সংজ্ঞা দেয়াও দুরূহ। তবে দেকার্তের চিন্তার সূত্র ধরে হেগেলের বয়ানে যদি বলি- কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা ক্রিয়াকে জানতে হলে আগে তার নেগেটিভিটি বা নাকারকে জানতে হয়। সে অর্থে পারফরম্যান্স আর্টকে বুঝতে হলে জানতে হবে এটি কী নয়। এটি প্রচলিত আর্ট নয়; নয় পেইন্টিং, এটা নয় ভাস্কর্য, নয় অভিনয়, নাট্যকলা, নৃত্যকলা, সংগীত ইত্যাদি। দর্শনের বা ইতিহাসের প্যারাডাইমকে যদি স্বীকার করি আবার পারফরম্যান্স আর্ট-এর বাইরেও কিছু নয়। আরও খোলাসা করে বললে, অন্য সব আর্টের মতো এটি ক্রয়-বিক্রয়ের কোনো পণ্য নয়, নয় স্থানান্তরযোগ্য কোনো বস্তু। শিল্পকলার ইতিহাসে অন্য সব ইজমের মতো পারফরম্যান্স আর্টও একটি বৈপ্লবিক ধারণা। এ বিবেচনায় পারফরম্যান্স আর্টকে আমরা নিন্মোক্ত কিছু সংজ্ঞায়িত করতে পারি- এটি একটি জীবন্ত শিল্প, কারণ এর দ্যোতনা আছে। যেহেতু এটি একটি পরীক্ষামূলক আর্ট; অন্য সব আর্টের মতো কোনো নিয়মের ধার ধারে না; এটা অনুগ্রহভাজন নয়, একে অধিগ্রহণ করারও প্রশ্ন ওঠে না। যেহেতু এটা কোণো পণ্য নয়, সুতরাং এর মালিকানাও নেই। পারফরম্যান্স আর্টিস্টরা কোনো স্থান বা সময়ে বন্দি নয়। তারা যেকোনো স্থানে যেকোনো সময়ে তাদের শিল্পকর্মের প্রদর্শন করতে পারেন। পারফরম্যান্স আর্টিস্টরা রাষ্ট্র, সমাজ, নিয়ম বা আইনের সীমা মানতে বাধ্য নন। তারা নিয়মের ব্যতিক্রমই শুধু নন; অতিক্রমও।
পারফরম্যান্স আর্টের ধারণাটি ইজম হিসেবে ইমপ্রেশনিজম বা দাদাইজিমের মতো হঠাৎ করেই পয়দা হয়েছে বলা যায়। কোনো লেআউট করে বা পরিকল্পনামাফিক এর জন্ম হয়নি। ইতিহাসের অনেক বড় বড় ঘটনার জন্মই আকস্মিকভাবে। এটিও তাই। তবে পারফরম্যান্স আর্টের আনুষ্ঠানিক সূচনাপর্ব আমরা ধরতে পারি উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে। এর আগেও ব্যক্তিবিশেষের মধ্য দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে এ শিল্পের কিছু ইঙ্গিত আমরা পাই। বিশেষ করে কবিতায় শার্ল বোদলেয়ার প্রথাগত সত্যম শিবম সুন্দরমের ক্লাসিক ফর্ম বা শৈলী-ই শুধু ভাঙলেন না, আধুনিক কবিতাবিমুখ মধ্যবিত্ত শ্রেণির চেতনাকে ধাক্কা দিতে তিনি উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়ালেন ওই শ্রেণির আবাসস্থলে। তার ওই সময়ের কর্মকান্ড মাতালের উন্মাদনা মনে হতে পারে অনেকের কাছে-কিন্তু তার ওই উলঙ্গ পারফরম্যান্স শিল্প-সাহিত্যে নতুন একটি চিন্তার জন্ম দিয়েছে। তবে বোদলেয়ারের ওই কর্মকান্ডকে আধুনিক বিচারে হয়তো পারফরম্যান্স আর্ট বলা যাবে না; আবার পারফরম্যান্স আর্টিস্টরা যে বোদলেয়ার থেকে অনুপ্রেরণা নেননি তাও নয়। ইতালিতে তরুণ অ্যানার্কিস্টরা বুর্জোয়া মধ্যবিত্তের রুচিবোধকে চরম আঘাত করেন সম্ভবত বোদলেয়ারের অনুপ্রেরণা থেকেই।
বিশেষত ইউরোপে পারফরম্যান্স আর্টের সূচনাপর্ব উনিশ শতকের শেষ বা বিশ শতকের গোড়ার দিকে হলে এর উৎকর্ষের কাল ধরা হয় গত শতকের ষাটের দশকে আমেরিকায়। অনেকে দ্বিমত করলেও আমেরিকাকে আমি ইউরোপ-ই বলব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষের মনোজগতে নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। এ সময় দর্শনের গণ্ডি পেরিয়ে অস্তিত্ববাদী ভাবনা সাহিত্যে জায়গা করে নেয়। নারীবাদী ধ্যানধারণা বিপ্লবী রূপ নেয় ষাটের দশকেই। প্রচলতি মনস্তত্ত্বের কাঠামো ভেঙে ডেভিড কুপারের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় এন্টি-সাইকিয়াট্রির। সাউথ আফ্রিকার মার্কসবাদী এ মনস্তত্ত্ববিদ ইংল্যান্ডে তার আন্দোলন সূচনা করেন। ওই সময় জুটে যায় তার অনেক শিষ্যও। তার মনস্তাত্ত্বিক ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করেন ব্যক্তিবিশেষের নয়; রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে। তিনি রোগীদের নয়; সমাজ, রাষ্ট্র ও তথাকথিত সুস্থ মানুষদের চিকিৎসার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন। ষাটের দশকের এন্টি-সাইকিয়াট্রি আন্দোলন শিল্প-সাহিত্য-দর্শনে নতুন নতুন ভাবধারার জন্ম দেয়। এন্টি-সাইকিয়াট্রিদের মূল কথা হলো- মানসিক অসুস্থতার জন্য ব্যক্তি নয়; সমাজ বা রাষ্ট্র দায়ী। মানসিক রোগীদের রোগ নির্ণয়ের প্রচলিত পদ্ধতি ও চিকিৎসাব্যবস্থারও বিরোধিতা করেন এই মনস্তত্ত্ববিদেরা। তাদের মতে প্রচলিত ও অসুস্থ সমাজকে সুস্থ করে তুলতে পারলে মানসিক রোগ এমনিতেই সেরে যাবে। এন্টি-সাইকিয়াট্রি আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে মিশেল ফুকো লিখেন তার বিখ্যাত রচনা ‘মেডনেস অ্যান্ড সিভিলাইজেশন: এ হিস্টোরি অব ইনসানিটি ইন দ্য এইজ অব রিজন’। সেখানেও তিনি মানসিক অসুস্থতার জন্য প্রচলিত সমাজকাঠামোকেই দায়ী করেন এবং আর্জি জানান সমস্ত পাগলাগারদ ভেঙে ফেলার।
ষাটের দশকে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ; বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক বোমার বিস্তার ও পুঁজিবাদের উন্মত্ত আচরণের বিরুদ্ধে দার্শনিক, শিল্পী, সাহিত্যিকরা তাদের আবেগের পুরোটাই ঢেলে দেন। মার্কিন তরুণরা ভিয়েতনামে চাপিয়ে দেয়া অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাদের নিজ দেশের প্রশাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেন। সে সময়ের তারুণ্যের উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ে শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনেও। কাগজ-কলম, রং তুলি বা হাতুড়ি-বাটালে সীমাবদ্ধ না থেকে শিল্পীরা শরীর দিয়ে অনুভব করেন মানুষের দুঃখবোধ, লাঞ্ছনা, ক্ষুধা, ভয় ও ব্যথা। শিল্পীরা হাজির হন গণমানুষের কাতারে। জাপানের গুইটা দলের কাজু শিরাগা কাদায় গড়াগড়ি দিয়ে নিজের শরীরে ভাস্কর্যের আদল দেন। জর্জ মেথুস ছবি আঁকার কালি এলোমেলো ছুড়ে দেন ক্যানভাসে। জ্যাকশন পোলক তার স্টুডিওর মেঝেতে ফেলে রাখা ক্যানভাসে ঘুরে বেড়ান নাচের ভঙ্গিতে। জাপানি ফ্লুক্সাস আর্টিস্ট ইউকো ওনো ১৯৬৯ সালে আমস্টারডামে যোগ দেন স্বামী জন লেলনের কনসার্টে। সেখানে তারা দুজন বিখ্যাত বা জনপ্রিয়তার দেয়াল ভেঙে সাধারণ মানুষের কাতারে একাত্ম হয়ে যান। এ দুজন প্রকাশ্যে সাধারণের মাঝে তাদের একটি বেডরুম তৈরি করে হাত ধরাধরি করে বসে থাকেন। এই প্রতীকী বিছানা অভিজাতের অন্দরমহল আর রাস্তায় থাকা মানুষের দূরত্ব কমিয়ে দেয়ারই একটি বাসনা।
কেবল চিত্রশিল্পী বা ভাস্করেরাই নয়, অন্য মাধ্যমের শিল্পীরাও যোগ দেন পারফরম্যান্স আর্টে। আমেরিকার বিখ্যাত মিউজিক কম্পোজার জন কেইজ সুনসান চার দেয়াল থেকে বের হয়ে সাধারণ মানুষের হট্টগোলের মধ্যে এসে বেহালার সুর তোলেন। তার ক্লাসিকের সঙ্গে একাকার হয়ে যায় মানুষের হইচই, হাসি-তামাসা, দুঃখ-বেদনা। অনেক বছর পর ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা একটি পরীক্ষা চালায় বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা বেহালাবাদক জশুয়া বেলকে দিয়ে। ব্যস্ততম মেট্রোরেলের সাবওয়েতে সাধারণ জীর্ণ পোশাকে জশুয়া বেল সুর তুলেন সেবাস্তিয়ান বাখের জটিলতম সিক্স পিসেস। দু-চারজন আসা-যাওয়ার পথে কয়েক সেন্ট ভিক্ষা দিলেও বিশ্বখ্যাত এ ভায়োলিনিস্ট বা তার সুরের প্রতি কারো আগ্রহ-ই লক্ষ করা যায়নি। অথচ দুই দিন আগেও বোস্টনের এক থিয়েটার হলে গড়ে এক শ ডলারে জশুয়া বেলের বেহালা শুনতে গিয়েছেন সহস্রাধিক মানুষ। জশুয়া বেলের ওই পরীক্ষা পারফরম্যান্স আর্টের সূত্রের মধ্যে না থাকলেও মধ্যবিত্তের রুচিবোধ তৈরি হয় ব্যক্তির কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে নয়, পরিবেশের অবস্থান থেকে- তার প্রমাণ পাওয়া যায়। জন কেইজ মধ্যবিত্তের চারদেয়ালের মনোরম পরিবেশ থেকে বের হয়ে আসেন নিচুতলার মানুষদের কাছে। আর জশুয়া বেল দেখান মানুষের যান্ত্রিক জীবনের চলমানতায় হারিয়ে যাচ্ছে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু মনোরম; মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে মানুষরে সত্তা থেকে।
১৯৭০-এর শুরুতে মার্কিন আর্টিস্ট ক্রিস বার্ডেন ও জার্মানির জোসেফ বায়েজ আমেরিকাসহ ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী নীতি ও তাদের দেশের মানুষের নিরাপত্তা রক্ষার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। ১৯৭৪ সালে প্রদর্শন করা জোসেফ বায়েজের পারফরম্যান্স ‘আই লাইক আমেরিকা অ্যান্ড আমেরিকা লাইক মি’-আমেরিকার নষ্ট রাজনীতির চরম প্রতিবাদ। ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী ওই পারফরম্যান্স আর্ট প্রদর্শনীতে তিনি গ্যালারিতে একটি নেকড়ের সঙ্গে কাটিয়ে দেন বেশ কয়েক দিন। নেকড়েটি ছিল আমেরিকার-ই প্রতীক। বায়েজের লড়াই নেকড়ে রূপি আমেরিকার বিরুদ্ধে। এর আগে তিনি পণ করেছেন, আমেরিকার অপবিত্র মাটিতে নিজের পা ছোঁয়াবেন না; তাই তিনি বিমানবন্দর থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে গ্যালারিতে গিয়ে ওঠেন। কিন্তু পা ফেলেন না মাটিতে। তার ওই পারফরম্যান্সে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালও প্রতীক হিসেবে এসেছে। ওই পত্রিকা তিনি নেকড়ের হাগু পরিষ্কারের কাজে ব্যবহার করেন। নেকড়ে রূপি আমেরিকাতে থেকে নির্গত মল সাফসুতোর করে আমেরিকাকে বাঁচিয়ে রাখছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতো এ জাতীয় পত্রিকা বা গণমাধ্যমগুলো।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে ক্রিস বার্ডেনের করা শ্যুট বা গুলি অনেকটা হৃদয়গ্রাহী ও বেদনাদায়ক। এর ঝুঁকিও ছিল মারাত্মক। ক্রিস একটি দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, তার এক বন্ধু পয়েন্ট টু টু বোরের একটি বন্দুক দিয়ে তাকে গুলি করছেন। আরেক বন্ধু ক্যামেরা দিয়ে ভিডিওচিত্র ধারণ করছেন। ক্রিসের ওই পারফরম্যান্সের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে মানবতার বিরুদ্ধে মার্কিন রাষ্ট্রের নিষ্ঠুরতা।
১৯৭৩ সালে মারিনা আব্রামোভিকের রিদম বা ছন্দ পারফরম্যান্সের আর্টের একটি ভিন্ন ধারা নিয়ে আসে। তিনি পর্যায়ক্রমে ২০টি ছুরি দিয়ে দ্রুত তার পাঁচ আগুলের ফাঁক দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যান। তার ওই এক ঘণ্টার পারফরম্যান্স ছিল শ্বাসরুদ্ধকর। একটু এদিক-সেদিক হলে তাকে আংগুল হারাতে হতো। আব্রামোভিচের ওটি ছিল রিচুয়াল (আচার) পারফরম্যান্স। এর পরে অনেক প্রদর্শনীতে তিনি দীর্ঘদিন ভুখা থেকে মানুষের দুঃখ-বেদনা নিজের ভেতরে অনুভব করতেন। তিনি অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী অ্যাবরোজিন ও প্রাচ্যের সুফিদের কাছ থেকে তার রিচ্যুয়ালের নানা শিক্ষা গ্রহণ করে পারফরম্যান্স আর্টে ব্যবহার করেন।
ষাটের দশকে নারীবাদী শিল্পীরা পারফরম্যান্স আর্টে নতুন মাত্রা নিয়ে আসেন তাদের শরীর উন্মুক্ত করে। ক্যারোলি স্নিমান, হান্না ইউলকে ও ভালি এক্সপোর্ট তথাকথিত সভ্যতার মোড়ক খুলে তাদের শরীর উন্মুক্ত করে জনসম্মুখে প্রদর্শন করেন। ওই সময় নারীমুক্তি আন্দোলনের এ ধারণা নিয়ে বিশ্বব্যাপী নানা বিতর্ক দেখা দিলেও তাদের সাহসী কর্মকান্ড তথাকথিত সভ্যতা ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই একটি বড় কম্পন।
১৯৭৫ সালে করা ক্যারোলিন স্নিমানের ‘ইনটেরিয়র স্ক্রল’ নারীবাদী ইস্যুতে সবচেয়ে বিপ্লবী প্রদর্শন। নির্বসনা ও আঁকিবুঁকি করা স্নিমান একটি টেবিলের ওপর ত্রিভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে কাগজের দড়ি বানিয়ে তার যোনিক্ষেত্রে প্রবেশ করান। তার নির্মিত ভিয়েতনামের যুদ্ধ নিয়ে একটি চলচ্চিত্রের সমালোচনা করেন এক পুরুষ চলচ্চিত্রনির্মাতা। এটি ছিল ওই সমালোচনার বিরুদ্ধে তার পাল্টা আক্রমণ।
এর পূর্বাপর অনেক আর্টিস্ট দুর্বৃত্তপনা ও অনাচারের বিরুদ্ধে পারফরম্যান্স আর্টকে তাদের হাতিয়ার করেছেন। এই স্বল্প পরিসরে এর বিস্তারিত যাওয়ার কোনো উপায় নেই। যাওয়ার প্রয়োজনও নেই। ঘটনা বা উদাহরণগুলো আনা হয়েছে পারফরম্যান্স আর্টের চরিত্র বোঝার জন্য। ঘটনার পর আমরা এর তত্ত্ব বিচার করে আরও কিছুটা খোলাসা করার চেষ্টা করব।
পারফরম্যান্স আর্ট ও সেলফ-কনশাসনেস
পারফরম্যান্স আর্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ বা অ্যাসোসিয়েশন হচ্ছে সেলফ-কনশাসনেস বা স্বজ্ঞা। পারফরম্যান্স আর্টের ক্ষেত্রে ব্যক্তির ভূমিকাই প্রধান। ব্যক্তি মানে এখানে স্বয়ং শিল্পী। রং, তুলি, ক্যানভাস, হাতুড়ি, বাটাল- এসবই শিল্পীর অঙ্গ, কিংবা শিল্পীর অঙ্গই ছবি আঁকা বা ভাস্কর্য তৈরির উপাদান। তবে শুধু এটুকু বললে সেলফ-কনশাসনেসের স্বরূপ বোঝা যাবে না। বুঝতে হবে আদার বা অপর দিয়ে। সেলফ বা নিজের ক্ষেত্রে ব্যক্তির ভূমিকা গৌণ। আমি-সত্তা দিয়ে সেলফ হয় না; আমরা হতে হয়। সামষ্টিক সত্তাই সেলফ। আদার বা অপর যদি না চিনে বা কগনিশন না করে, তাহলে সেলফ হতে পারে না। আদার সেলফকে কগনাইজ করবে এবং সেলফ আদারকে কগনাইজ করবে। এভাবে উভয়ের মধ্যে রিকগনাইজ বা জানাজানি হবে। এখন কথা হলো আদার বা অপর কী? আমরা যা দেখি তা-ই আদার। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সকল বস্তুই অপর। সেটা হতে পারে সমাজ, রাষ্ট্র, মানুষ, মানুষের অনুভূতি, আনন্দ, দুঃখ, বেদনা ইত্যাদি। আধুনিক গুরু দার্শনিক ডেভিড হিউম যেমন বলেন, আই অ্যাম নাথিং বাট এ বান্ডল অব পারসেপশন। অর্থাৎ আমরা যা পারসিভ বা ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করি- এটাই আমি। প্রজ্ঞাবাদী দার্শনিক দেকার্ত যখন বলেন, আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি। এখানে চিন্তাকে তিনি নিজের প্রজ্ঞা দ্বারা বিচার করছেন, অভিজ্ঞতা দ্বারা নয়; কিন্তু তার চিন্তাও ইমিডিয়েট বা বস্তুনিরপেক্ষ নয়। মিডিয়েশন ছাড়া কোনো চিন্তা আসতে পারে না। চিন্তা শব্দের মধ্যেই মিডিয়েশন বা পারসেপশন আছে।‘চিন্তা’ শব্দটাকে ভাঙলে পাই- চিন তা। এখানে ‘তা’ বা অপরকে চিনলে বা রিকগনাইজ করলেই জানার বা কনশাসনেসের উদ্ভব হয়। অর্থাৎ পারসিভের গর্ভেই সেলফের জন্ম।
পারফরম্যান্স আর্টিস্টরা অনেক সময় চূড়ান্ত মাত্রায় আত্মনিগ্রহ করে থাকেন। এই আত্মনিগ্রহ বা মেসোসিজম সমাজের নিবর্তনমূলক ব্যবস্থারই শারীরিক প্রকাশ। নষ্ট রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে বসবাস করা সাধারণ মানুষের দুঃখ, বেদনা, ভয়, মানসিক বৈকল্য একজন শিল্পীর ইন্দ্রিয়কে স্পর্শ না করলে সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা থাকলো কোথায়? এটা না থাকলে আর্ট বা শিল্পচর্চা এখনো বুর্জোয়াদের ড্রয়িংরুমের ইনটেরিয়র হিসেবেই সীমাবদ্ধ থাকতো। সুতরাং পারফসিভ বা ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে সমাজের বিষয়-ই শিল্পীর বিষয়ী হিবেবে হাজির হয় এবং তিনি সেলফ কনশাসে রূপান্তরিত হন।
পারফরম্যান্স আর্ট ও ইনটেশনালিটি
ইনটেনশনালিটি একটি দার্শনিক ফেনোমেনা বা বিষয়। এর সঙ্গে পারফরম্যান্স আর্টের সম্পর্ক কী। কোনো শিল্প বা যেকোনো কিছু দর্শনের ভেতর দিয়ে না গেলে এর প্রাণ থাকে না- হেগেল তার ফেনোমেনোলজি অব স্পিরিট গ্রন্থের ভূমিকায় এমনটাই দাবি করেছেন। আমরা এখন দেখবো ইনটেনশনালিটি আসলে কী। ল্যাটিন থেকে আসা ইংরেজি ইনটেনশন শব্দের অর্থ আমরা জানি- অভিপ্রায়, আকাঙ্ক্ষা, বাসনা, ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য। ইনটেনশনালিটি এসবের উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে না। মোটা দাগে ইনটেনশনালিটির কোনো উদ্দেশ্য নেই; এবং এই যে উদ্দেশ্য নেই, সেই উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করাই তার উদ্দেশ্য। জার্মান দার্শনিক ফ্রান্স ব্রেনতানো (১৮১৩-১৯১৭) মনস্তাত্ত্বিক জায়গা থেকে শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তবে শব্দটি নতুন নয়। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের লেখায়ও এর ব্যহার দেখতে পাই। মধ্যযুগের খ্রিস্টান স্কলাস্টিক দার্শনিকেরা ধর্মতত্ত্বের আলোচনায় শব্দটির প্রথম জুতসই ব্যবহার করেন। তবে ব্রেনতানোর ব্যবহারে এটির নতুন মাত্রা এসেছে। আগেই বলেছি কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করা ইনটেনশালিটির উদ্দেশ্য নয়। ব্রানতানোর ভাষায় আমাদের মনের মধ্যে সব সময়ই কোনো না কোনো বিষয় ক্রিয়াশীল থাকে। অস্তিত্বশীল বিষয়ের প্রতি আমাদের ভাবনা যে নিবিষ্ট থাকবে তার কোনো কথা নেই। আবার বিষয়হীন চিন্তা বলেও কিছু নাই। অর্থাৎ চিন্তা মাত্রই বিষয়নিষ্ঠ। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়- ক্লিওপেট্রা ও জুলিয়াস সিজার দুটি ঐতিহাসিক চরিত্র। তাদের প্রেমকাহিনি, ট্রাজেডি আমাদের মনকে আন্দোলিত করে। আবার তলস্তয়ের উপন্যাসের চরিত্র আন্না কারেনিনার দুঃখ, আনন্দ, ভালোবাসা, ঘৃণায় আমরা সমানভাবে আলোড়িত হই। ফিকশনের চরিত্র আন্না কারেনিনা যেহেতু আমাদের মনের ভাবনার মধ্যে রয়েছে, সুতরাং সে নাই- এমনটাও বলা যাচ্ছে না। আমাদের চিন্তার বিষয় না হলেও দৈনন্দিন নানা বিষয়- ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজ, মানুষ, গুম, ক্রসফায়ার, ভয়, আতঙ্ক, ক্ষুধা, রাগ, দুঃখ, কামনা, বাসনা আমাদের ভাবনার মধ্যে এসে হাজির হয়। এসবই আমাদের মনোজগতে এসে ভিড় জমায়। সে অর্থে ইনটেনশনালিটি বলতে আমরা বুঝতে পারি, আমাদের পারিপার্শ্বিক বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু বা পারসিভ বা উপলব্ধি বা মনেবৃত্তি বা ভাবকে। এখন পারফরম্যান্স আর্টের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী। এই সময়ের অনেক আর্টিস্ট বলে থাকেন- পারফরম্যান্স আর্টের কোনো দর্শন নেই, উদ্দেশ্য নেই, লক্ষ্যও নেই। এটা কেবল শিল্পীর স্বায়বব্ধতার মধ্য দিয়ে আনন্দ-বেদনার প্রকাশ। এই কথার সূত্র ধরে আমরা ক্রোচের চিন্তার জগতে একটু প্রবেশ করব। ক্রোচের ভাষায়, ‘Art cannot be a utilitarian act, and since a utilitarian act aims always at obtaining a pleasure and therefore at keeping off a pain, art considered in its own nature, has nothing to do with the useful and with pleasure and pains as such. (Croce, The Essence of Aesthetic)
ক্রোচের ভাবনাকে যদি মেনে নেই- শিল্পের অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই, আনন্দ-বেদনার জন্ম দেয়া ছাড়া এর কোনো ব্যবহারিক উপযোগিতা নেই। এখন পারফরম্যান্স আর্টকে যদি ক্রোচের শিল্পভাবনার সঙ্গে মেলাই, তাহলে পারফরম্যান্স আর্টের জন্মপ্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। পারফরম্যান্স আর্ট নিছক নয়; এর ছক আছে। কোনো ছক বা উদ্দেশ্য ব্যক্তির ভাবনার বাইরে নয়। ছক নাই বললেও একটা কিছু থেকে যায়। ওই যে, যে থেকে যাওয়া, তা নিয়েই পারফরম্যান্স আর্ট কাজ করে। দর্শনের ইনটেনশনালিটির সঙ্গে এখানেই পারফরম্যান্স আর্টের সম্বন্ধ। আরেকটা বিষয় আছে, পারফরম্যান্স আর্ট একটি কনসেপচুয়াল আর্ট বা ধারণাগত ক্রিয়া। ইনটেমনশনালিটিও তাই। এখন এ ধারণার ধরন কেমন হকে তা শিল্পী নিজে নির্ধারণ করবে।
পারফরম্যান্স আর্ট ও বাংলাদেশ
লেখার শুরুতে মোটা হরফের বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম ‘পারফরম্যান্স আর্ট: ইউরোপের পাসপোর্টে বাংলাদেশে প্রবেশ’। এর প্রবেশ প্রক্রিয়াটা কী ধরনের ছিল এবং এখন কোন অবস্থায় আছে, তা নিয়ে কিছু আলোচনার দাবি রাখে। এ নিয়ে নানা বিতর্ক হতে পারে, দ্বিমত থাকতে পারে। থাকাটা জরুরি; উচিতও।
শুরুর দিকে পারফরম্যান্স আর্ট যে বিপ্লবী চেতনা নিয়ে হাজির হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে তা থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছে। পারফরম্যান্স আর্টেরও এখন গ্রাহক তৈরি হয়েছে। হয়েছে পণ্যে রূপান্তরিত। গ্রাহক তৈরি হওয়ায় অনুগ্রভাজন বা ইনস্টিটিউট এসে পারফরম্যান্স আর্টকে অধিগ্রহণের জন্য নানা মূল্য নির্ধারণ করে দিচ্ছে। জন্মপ্রক্রিয়ায় পারফরম্যান্স আর্টের যে রূপ ছিল- গত শতকের নব্বই দশকের পর থেকে তার আমূল রূপায়ণ ঘটেছে। এখন পারফরম্যান্স আর্ট নিছকই আর্ট। নিছকের এ অবস্থান থেকেই পারফরম্যান্স আর্ট বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অনুমান করা হয় নব্বই দশকের শেষের দিকে কালিদাস কর্মকার প্রথম এ দেশে পারফরম্যান্স আর্টের সূচনা করেন। (চলবে)
khub i faltu type likha....... r information er kotha to bollam naa.....
লিখা টা পড়ে মনে হলো ঢাকা মানেই বাংলাদেশ !! লেখকের উচিত ছিল পারফরম্যান্স আর্ট: ইউরোপের পাসপোর্টে ঢাকায় প্রবেশ শিরোনাম দেয়া , দেশের বেশির ভাগ আঁতেল বুদ্ধিজীবিদের একই দশা , একটা প্রদর্শনী দেখে একটা মহা কাব্য লিখা !! ঢাকা বাইরে চট্টগ্রাম ,রাজশাহী ,খুলনা ও বাংলাদেশ উনারা হয়ত জানেন না ! ছবির হাত এর এই প্রদর্শনীর পূর্বে চট্টগ্রামে পারফরমেন্স আর্ট এর যে প্রদর্শনী গুলো হলো সেইটা ইতিহাসে থাকবেনা কারণ এ তো রাজধানী না , রাজধানীতে যা হয় তাই ইতিহাস ,..হে হে হে ,,...সন্মানিত লেখকের জন্য এই লিংক টা পাঠালাম , সময় পেলে দেখার অনুরোধ রইলো ,...শুভেচ্ছা ,.... http://www.porapara.org/performance-art/
`অনুগ্রহভাজন নয়' কথাটা ঠিক নয়। পারফরমেন্স কিংবা ইন্সটলেশন ‘অতি অনুগ্রহভাজন’ শিল্প। প্রর্দশন স্থান, কাল, সময় ব্যতিত উহা পাগলামী। জশুয়া বেল-ই প্রমান, জগতের অন্যতম সেরা বেহালাবাদক সহশ্রাব্দ প্রাচীন ভিক্ষুক হিসেবেই পরিগনিত হন... সেই ১৯৮৯-৯০ সালে এইসব আয়োজন করতে গিয়েই বুঝেছি... শিপু, অভি কিংবা কালীদাসের তৎকালীন পারপরমেন্স ও ইন্সটালেশন... গত ২৪ বছরে বহুভাবে ভেবেছি... মাঝে মাঝে মনে হয় ‘এই সব অক্ষমের নিজেকে খ্যাতিমান বানানোর প্রয়াস নয়তো’... যদি সেটা হয় তবে চাতুর্যই সান্তনা... মানুষ ব্যতীত অন্যকোন প্রানীতো আর চাতুর হতে পারে না...