। অঞ্জন আচার্য ।
১৯৫৫ থেকে ১৯৫৬ সাল। কাইয়ুম চৌধুরী নানা ধরনের ব্যবহারিক কাজ করেছেন, যুক্ত থেকেছেন বিজ্ঞাপনী সংস্থার সঙ্গে, আর কাজ করেছেন বইয়ের প্রচ্ছদ ও সচিত্রকরণের। সিগনেটের বই কাইয়ুম চৌধুরীর জন্য ছিল এক অনুপম নিদর্শন। সাময়িকী পত্রিকা বিষয়ে আগ্রহী কাইয়ুম চৌধুরী, ‘ছায়াছবি’ নামে একটি চলচ্চিত্র সাময়িকী যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেছিলেন কিছুদিন। সুযোগমতো অল্প-স্বল্প প্রচ্ছদ আঁকছিলেন এবং এই কাজের সূত্রেই পরিচয় সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে। ১৯৫৫ সালে তাঁর দুই বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন, কিন্তু প্রকাশক অপারগ হওয়ায় আর আলোর মুখ দেখেনি সেই বই। প্রচ্ছদে একটি পালাবদল তিনি ঘটালেন ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত জহুরুল হকের সাত-সাঁতার গ্রন্থে। গ্রন্থের বক্তব্যের বা সারসত্যের প্রতিফলন ঘটালেন প্রচ্ছদে, একই সঙ্গে গ্রাফিক ডিজাইনে কুশলতা ও নতুন ভাবনার ছাপ মেলে ধরলেন তিনি। এমনই দক্ষতার যুগল মিলনে আঁকলেন ফজলে লোহানী রচিত ‘কথাসরিৎসাগর’-এর প্রচ্ছদ, যা প্রকাশিত হয়নি। গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের ‘সচিত্র সন্ধানী’ পত্রিকার আত্মপ্রকাশ তাঁর অঙ্কন, টাইপোগ্রাফিবোধ ও রসসিঞ্চিত তির্যক রচনা প্রকাশের মাধ্যমে হয়ে উঠেছিল অনবদ্য। শিক্ষাজীবন প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে কাইয়ুম চৌধুরী বলেছিলেন, ‘আমি আমার শিল্পীজীবন যখন শুরু করি আমার সঙ্গে যাঁরা ছিলেন কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, গায়ক- এদের সবার মধ্যে একটা যোগাযোগ ছিল। যেমন, আমার বন্ধুস্থানীয়দের মধ্যে আমার খুব ঘনিষ্ঠতম বন্ধু- যার সঙ্গে আমি একই সঙ্গে রাতও কাটিয়েছি, তিনি সৈয়দ শামসুল হক। তারপর শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। আমরা একসময় একই সঙ্গে কাজ করতাম।’ [সাপ্তাহিক ২০০০, ২২ অক্টোবর ১৯৯৯, পৃষ্ঠা : ৪৭]
১৯৫৭ সালে আর্ট কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দেন কাইয়ুম চৌধুরী। আর্ট কলেজে নিজের দুই বছরের কনিষ্ঠ তাহেরা খানমকে ১৯৬০ সালে বিয়ে করেন তিনি। ওই বছরই কাইয়ুম চৌধুরী আর্ট কলেজ ছেড়ে যোগ দেন কামরুল হাসানের নেতৃত্বে নবগঠিত ডিজাইন সেন্টারে। ১৯৬১ সালে ডিজাইন সেন্টার ছেড়ে অবজারভার হাউজে চিফ আর্টিস্ট হিসেবে যোগদান করেন। অবজারভার পত্রিকার রবিবারের সাময়িকীতে ডিজাইন নিয়ে যেসব নিরীক্ষা করতেন, তাঁর শিক্ষক জয়নুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পরে ১৯৬৫ সালে আবার আর্ট কলেজে ফিরে যান কাইয়ুম চৌধুরী। সবশেষ চারুকলা ইনস্টিটিউট হওয়ার পর এর অধ্যাপক হিসেবে তিনি ১৯৯৪ সালে অবসর নেন।
১৯৫৯ সালের ঘটনা। বন্ধুবর গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের সন্ধানী প্রকাশনী যাত্রা শুরু করে জহির রায়হানের ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে। ১৯৬১ সালে মাওলা ব্রাদার্স সৃজনশীল প্রকাশনার অধ্যায় উন্মোচন শুরু করে আবদুশ শাকুরের ‘ক্ষীয়মাণ’ এবং সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যগ্রন্থ ‘একদা এক রাজ্যে’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ দুই প্রকাশনা সংস্থার কাজের পেছনে বরাবরই কাইয়ুম চৌধুরী সক্রিয় থেকেছেন। তিনি আরও প্রচ্ছদ আঁকেন ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। ১৯৫৯ ও ১৯৬১ সালে রেলওয়ের টাইমটেবিলের প্রচ্ছদ এঁকে সেরা পুরস্কারটি লাভ করেন তিনি। তেলরং, জলরং, কালি-কলম, মোমরং, রেশমছাপ ইত্যাদি নানা মাধ্যমে কাজ করেছেন তিনি। তাঁর একটি প্রবণতা ছিল জ্যামিতিক আকৃতির অনুষঙ্গ। বস্তুত তাঁর ছবি নকশাপ্রধান। বর্ণিল পটভূমিতে মোটা দাগের নকশা তাঁর প্রধানতম অঙ্কনশৈলী। অন্যদিকে কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্রাবলি বর্ণোজ্জ্বল। এদিক থেকে আঁরি মাতিসের সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য পাওয়া যায়। লাল, নীল, সবুজ- এই তিনটি রং তিনি প্রচুর ব্যবহার করেন তাঁর বিভিন্ন শিল্পকর্মে। এ বর্ণভঙ্গি ছিল তাঁর চিত্ররীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর ক্যানভাসের আয়তন প্রায়শ থাকতো বর্গাকার। এ ছাড়া তাঁর চিত্রাবলিতে এ দেশের লোকশিল্পসুলভ পুতুল, পাখা, হাঁড়ি, শীতলপাটি, কাঁথা ইত্যাদির পৌনঃপুনিক ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
তিনি শুধু ছবিই আঁকতেন না, ছবির মধ্যেই বাস করতেন। দেশজ চিত্রকলায় গ্রাফিক ডিজাইনকে তিনি তুলেছেন শূন্য থেকে শিখরে। তাঁর হাত ধরেই গ্রাফিক ডিজাইন পূর্ণতা পেয়েছে। বইয়ের প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জার পাশাপাশি তেলরং ও জলরঙে আবহমান বাংলা ও বাংলার লোকজ উপাদানগুলোকে চিত্রে আধুনিক ফর্মে ফুটিয়ে তোলার জন্য কাইয়ুম চৌধুরীর কৃতিত্ব স্মরণীয়। শিল্প বিশ্লেষকদের মতে, বইয়ের প্রচ্ছদের শিল্পমানকে নতুন এক মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নোট ডিজাইন এবং ম্যুরাল কমিটির সদস্য। শিক্ষকতা, পত্রিকার নামলিখন বা অলংকরণ, সামাজিক বিভিন্ন কর্মকা-ে অংশগ্রহণ ইত্যাদির পরও চিত্রকর্মই ছিল তাঁর প্রধান আরাধ্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, বাংলার চিরকালের কৃষক, কৃষাণী, প্রান্তিক নারী, ষড়ঋতু, পাখি, ফুল- এসবই ছিল চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরীর প্রিয় বিষয়।
প্রাবন্ধিক মফিদুল হকের ‘কাইয়ুম চৌধুরী : জীবনের অন্যতম বন্দনা’ শিরোনামের লেখাটি থেকে কিছু কথা তুলে ধরা হলে অপ্রসাঙ্গিক হবে না- ‘বরাবরই কাইয়ুম চৌধুরীর কাজে থাকে একধরনের চিত্রধর্মিতা, যা নিছক চিত্ররূপ হয়ে থাকে না, রং এবং ফর্মের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তিনি চিত্রের আপাতসারল্য অতিক্রম করে পৌঁছতে চান অন্যতর গভীরতায়। মানুষ যখন জীবনাভিজ্ঞতার নির্যাস আহরণ করে, দীর্ঘ জীবনপথ পাড়ি দিয়ে তাকাতে পারে অতিক্রান্ত সময়ের দিকে তখন আমরা স্বাভাবিকভাবে ধরে নিই জীবনের রং তাঁর কাছে ফিকে হয়ে আসে, ধূসরতা আচ্ছন্ন করে বোধ। …কাইয়ুম চৌধুরীর প্রিয় শিল্পী পল ক্লি একবার বলেছিলেন, ‘রং আমাকে আচ্ছন্ন করে।’ কাইয়ুম চৌধুরীও তেমনি রং দ্বারা আচ্ছন্ন হয়েছেন এবং রঙের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করতে চেয়েছেন শিল্পানুভূতি। লাল, হলুদ, নীল- এইসব প্রাথমিক রং তাদের সকল ঔজ্জ্বল্য নিয়ে ফুটে উঠেছে ক্যানভাসে। এমনকি কালো রঙের ব্যবহারেও কার্পণ্য করেননি শিল্পী। মোটা কালো রেখা অথবা কালোর ছোপ মিলবে অনেক ছবিতে। তবে সেই কালোও যেন চারপাশের ঔজ্জ্বল্য আরও বাড়িয়ে দেয়, স্বয়ং হয়ে ওঠে উজ্জ্বলতা। বৃষ্টিধোয়া প্রকৃতিতে যেমন সজীবতা, সদ্য-স্নাত নারীর যেমন স্নিগ্ধতা, সেই সতেজতা ও মাধুর্য যেন রঙের মধ্যে পুরে দিতে চান কাইয়ুম চৌধুরী। …ফর্ম নিয়ে জীবনভর কাজ করে চলেছেন কাইয়ুম চৌধুরী, নিজের জন্য বিশেষ সুবিধা তিনি গড়ে তুলতে পেরেছিলেন তাঁর কৃত ব্যবহারিক শিল্পে ফর্মের প্রয়োগ দ্বারা। জীবনভর তিনি ব্যবহারিক শিল্পের কত বিচিত্র ধরনের কাজই না করেছেন। প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে তাঁকে চেনে কয়েক প্রজন্মের মানুষ, তিনি প্রচ্ছদ চিত্রায়ণে শিল্পের যোগসাধন এমন এক মাত্রায় নিয়ে গেছেন, যার উদাহরণ বিশেষ মিলবে না। সংবাদপত্র সাময়িকীর রচনা-চিত্রায়ণ, প্রকাশনার লে-আউট, টাইপোগ্রাফি ইত্যাদি সকল দিকে তাঁর নজর এবং এইসব কাজ এমন এক নিবিষ্টতা ও মমতা দিয়ে তিনি করেন যা ব্যাখ্যা করা কঠিন। একেবারে আঁটসাঁট আড়ষ্ট যেসব কাজ, প্রতিষ্ঠানের লোগো তৈরি, লেটারহেড ডিজাইন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তিনি গ্রাফিক শিল্পীর কুশলতার সঙ্গে ফর্ম নিয়ে নানা খেলা যোগ করতে পারেন। পোস্টার, আমন্ত্রণপত্র, ব্রোশিওর, প্রচারপত্র, বিজ্ঞাপনের ডিজাইন- সব কাজই তিনি করেন আনন্দচিত্তে। তিনি ফর্মের যে-সারাৎসার খুঁজে ফেরেন সেই অনুসন্ধানের সামাজিক অবলম্বন হয়ে উঠেছে ব্যবহারিক শিল্পে তাঁর অবাধ বিচরণ। এই অনুসন্ধিৎসা এবং প্রয়োগজাত উপলব্ধি ফিরে ফিরে তাঁর ক্যানভাসে যে মূর্ত হয়ে উঠবে, সেটা বলা বাহুল্য। তবে আমাদের দেশে শিল্পবোধ ও শিল্পবিচারে যে আড়ষ্টতা ও গন্ডিবদ্ধতা, তার ফলে কাইয়ুম চৌধুরীর কাজের এ-মতো মাত্রা বুঝে নিতে শিল্প-সমালোচকদের অস্বস্তি দুর্নিরীক্ষ্য নয়।’ [কালি ও কলম, এপ্রিল সংখ্যা ২০১২]
সৈয়দ আজিজুল হকের একটি কথা দিয়ে লেখাটির ইতি টানছি। ‘সুন্দরের নিরন্তর সাধক’ শিরোনামের লেখাটি তিনি বলেছেন- ‘কাইয়ুম চৌধুরীর প্রতিটি ছবির কম্পোজিশনই এক প্রকার ডিজাইন। এই নকশাধর্মিতা লোকজশিল্পেরও অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই বাস্তবতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও নিজের কর্মধারা চিত্রশিল্পী ও ডিজাইনার হিসেবে তাঁর দুই সত্তাকে পরস্পরের পরিপূরক করে তুলেছে। ছবির জমিনে অবয়ব ভাঙার যেসব কলাকৌশল বা রঙের ওভারল্যাপিংয়ের আশ্রয় তিনি নেন, তা একইভাবে প্রচ্ছদ ও অলংকরণেও অনুসরণ করেন। ফলে চিত্রশিল্পী ও ডিজাইনার হিসেবে তাঁর দুই সত্তাকে আর পৃথক করা যায় না। এ দুই সত্তা পরস্পরের জন্য দ্বন্দ্বাত্মক না হয়ে তাঁর ক্ষেত্রে শক্তিবর্ধক হয়েছে। তা ছাড়া প্রচ্ছদে হস্তলিপি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তিনি সার্থকতার চূড়া স্পর্শ করেছেন। এই সিদ্ধির কারণ প্রচ্ছদকে শুধু দৃষ্টিশোভন করা নয়, গ্রন্থের বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলার বিবেচনাটিও তাঁর কাছে সব সময়ই মুখ্য।’ [দৈনিক প্রথম আলো, ৩০ নভেম্বর, ২০১৪]
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক
No Comments