[metaslider id=1134]
।মুন রহমান।
চৈত্র যাই যাই করছে আর আসছে বৈশাখ। শাহবাগের পরে পাবলিক লাইব্রেরি সীমানা ধরে যদি গত এক মাসের মধ্যে কেউ যেয়ে থাকেন তবে নিশ্চয়ই শুনতে পেয়েছেন পুরনো দিনের বাংলা ছায়াছবির কিছু ধুম ধারাক্কা গানের শব্দ। গানের উৎস খুঁজতে যে সকল উৎসাহী জনতা ঢুকে পড়েছিলেন চারুকলা অনুষদে, তাদেরকে আর নতুন করে বলবার কিছু নেই। বাংলা গানের মিষ্টি মধুর ঝঙ্কারের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা প্রাঙ্গণে অনুষদের একঝাঁক কর্ম উদ্যমী তরুণ শিক্ষার্থীদের ব্যবস্থাপনায় চলছে বৈশাখ বরণ প্রস্তুতি। এবারের বৈশাখ উদযাপনের মূল দায়িত্ব পালন করছে ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষের মাস্টার্সের(চূড়ান্ত) শিক্ষার্থীরা।
রাজধানি ঢাকা শহরের বৈশাখ উদযাপনের অন্যতম আকর্ষণ চারুকলা অনুষদের আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রা। তাই এই শোভাযাত্রা কে আকর্ষণীয় আর রঙ্গিন করে তুলতে দিন রাত চলছে কাজ। এবারের বৈশাখকে ঘিরে আছে আনন্দ উল্লাস আর সকল বাধা-বিপত্তিকে ছিন্ন করে এ জনপদের মানুষের এগিয়ে যাওয়ার গল্প। উগ্র সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকারকে ছিন্ন করে আলোর মশাল নিয়ে এগিয়ে যাবার প্রত্যয়ে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ঠিক করা হয়েছে “অনেক আলো জ্বালতে হবে মনের অন্ধকারে”।
বৈশাখের শোভাযাত্রার আয়োজনের প্রস্তুতি হিসেবে অনুষদ প্রাঙ্গণে চলছে বৈশাখী মেলা। এখান থেকে যে কেউ চাইলে জলরং চিত্র, মুখোশ, সরা, পাখি, জোড়া মুখোশ, প্রদীপ ইত্যাদি ঘর সাজানোর জিনিশ কিনে নিতে পারেন। বৈশাখ উদযাপনের সার্বিক দায়িত্ব পালন করছেন ভাস্কর্য বিভাগের কামরুল হাসান এবং গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের রাজিব হাসান। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেলো “শোভাযাত্রা এর অর্থ সংস্থানের জন্যই মূলত এসব মুখোশ এবং অন্যান্য শিল্পকর্ম বিক্রি করা। শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে অন্যান্য শিক্ষার্থীরা কাজ করে থাকেন, তবে এখানে সবাই সমানভাবে কাজ করেন। শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করা বাধ্যতামূলক নয় বা এজন্য কাউকে অর্থও প্রদান করা হয় না। মনের টানেই সবাই কাজ করতে আসেন, তবে অনেক সিনিয়র শিল্পী এবং সাবেক শিক্ষার্থীদেরকে আমন্ত্রণ জানাই আমরা”। কাঠামো নির্মাণের মূল কাজ তদারকি করছেন ভাস্কর্য বিভাগের লিটন পাল। তিনি জানালেন, “কাঠামো নির্মাণের আগে প্রতিটি কাঠামোর মডেল তৈরি করা হয় তারপর বাঁশ ও কাঠ দিয়ে অভ্যন্তরের অবকাঠামো নির্মাণ করে এর ওপর কাগজ সেঁটে রঙ করা হয়”। মূল কাঠামোর পাশাপাশি থাকছে মাছ, বাঘ ও শাবক, ছাগল ও ছাগশিশু, টেপাপুতুল, কাকাতুয়া, দুটি ময়ুর, ঘোড়া। এছাড়াও থাকছে বিভিন্ন মুখোশ, রাজা-রানি মুখোশ, পেঁচা, বাঘ, শিংহ, খরগোশ ইত্যাদি। এবারের স্কুলঘর এবং দেয়ালচিত্রের কাজে থাকছে নকশী কাঁথা চিত্রের প্রভাব। বৈশাখের দ্বিতীয় দিনে সন্ধায় থাকছে শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় যাত্রা “মমতাময়ী মা”।
ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (ইউডা) ফাইন আর্টস বিভাগের উদ্যোগে বাংলা নববর্ষ ১৪২২ উদ্যাপন করতে যাচ্ছে। শোভাযাত্রাটি ধানমন্ডির বিভিন্ন স্থান প্রদক্ষিণ করবে। শোভাযাত্রার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে নানা আকৃতির সাপ, বেজি ও শান্তির প্রতীক পায়রা। এ ছাড়া রাজা-রানি, ঘোড়া বিভিন্ন আকৃতির মাস্ক।
ফুরফুরে মেজাজেই চলছে বরিশাল চারুকলার বৈশাখ বরনের কাজ। এবারের কাজের সমন্বয়ক রিদওয়ান অয়ন ও সৈয়দ নাজমুল আলম জানিয়েছেন প্রতিবারের মতো এবারও “মঙ্গল শোভাযাত্রা” ব্রজমোহন বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে শুরু হয়ে বরিশাল সিটি কলেজ প্রাঙ্গণে শেষ হবে। বরিশাল চারুকলার হাত ধরে ১৩৯৯ সালে বরিশালে বৈশাখ উৎসব শিরোনামে শুরু হয় এই “আনন্দ শোভাযাত্রা’র”। সেই আনন্দ শোভাযাত্রা আজ বরিশালের প্রধানতম উৎসবে পরিণত হয়ে বৈশাখ উৎসব “মঙ্গল শোভাযাত্রা” শিরোনামে পরিচিতি পেয়েছে। এই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বৈশাখ উৎসবের অঙ্গ সৌষ্ঠবকে আরো বর্ণময় ও অর্থবহ করার লক্ষ্যে লোকজ শিল্প ও শিল্পীদের বরাবরের মতো এবারেও বরিশাল সিটি কলেজ প্রাঙ্গণে একত্রিত হয়েছেন। লোকজ শিল্পীরা তাদের শিল্পকর্মের পশরা সাজাবেন এই দিন। নতুন প্রজন্ম পরিচিত হবে আমাদের ঐতিহ্যের সাথে, পাশাপাশি লোকজ শিল্পীরা দেখতে পারবেন সারা দেশ থেকে সংগ্রহ করা অনেক লোক শিল্পের নমুনা। সিটি কলেজ প্রাঙ্গণে “লোকজ সংস্কৃতি প্রদর্শনী” শিরোনামে জারি গান, পুঁথি পাঠ, কবি গান, গাজীর গান সহ বিভিন্ন লোক ঐতিহ্যের প্রদর্শনী হবে।
পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন সিলেটর চারুমেলার কলাকুশলীরা। হাড়ি-পাতিলে নকশা আঁকা, রঙ্গিন মুখোশ তৈরীসহ বিভিন্ন চারুশিল্পের কাজে পুরোদমে ব্যস্ত চারুমেলা’র সকল শিক্ষক ও চারুশিক্ষায় নিয়োজিত একঝাঁক মেধাবী শিক্ষার্থী। সিলেট চারুমেলা’র পরিচালক দীপন দেব বলেন, “পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে শতাধিক রঙ্গিন মুখোশ, হাড়ি-পাতিলে নকশা আঁকাসহ বিভিন্ন ধরনের চারুশিল্পের কাজ করছে চারুমেলা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সকাল ১০টায় উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের নেতৃত্বে প্রশাসনের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলাভবন চত্বর থেকে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ বের হবে। তিন দিন ব্যাপী উৎসবের দ্বিতীয় দিনে সন্ধ্যা ৭টায় ছাত্রকল্যাণ ও পরামর্শদান কেন্দ্রের আয়োজনে সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। এছাড়া বৈশাখের তৃতীয় দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের নিবন্ধীকৃত সাংস্কৃতিক সংগঠনের পরিবেশনায় সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বয় করে বিভিন্ন বিভাগ, হল নিজ নিজ উদ্যোগে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করবে।
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) বাংলা নববর্ষ-১৪২২ উদযাপন উপলক্ষে ব্যাপক আয়োজন হাতে নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। উৎসাহ-উদ্দীপনায় জাঁকজমকপূর্ণভাবে বরণ করে নেওয়া হবে নতুন বছরকে। এ আয়োজন সফল করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্ট এন্ড গ্রাফিক্স বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। এবারের বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রায় হাতী, ঘোড়া, বর-বধু-পালকি ও ফোক পাখিসহ বিভিন্ন পশুপাখি এবং মুখোশ, শিকে-সরা অলংকৃতপাত্রসহ গ্রাম বাংলার নৈসর্গিক দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হবে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারি এবং পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বুলবুল ললিতকলা একাডেমির উদ্যোগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। এতে নওগাঁর বিখ্যাত সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘অষ্টক’-এর উদ্যোগে পরিবেশিত হবে লোক-সঙ্গীত।
No Comments