শিল্পকলায় কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি অর্জন না করলেও শিল্পের প্রতি অনুরাগ ধারণ করেছেন শৈশব থেকেই। কিন্তু রক্ষণশীল পারিবারিক বলয়ে শিল্পের প্রতি তাঁর অনুরাগ প্রশ্রয় পায়নি অভিভাবকদের কাছে। বারবার বাধার মুখেই পড়েছে ছবি আঁকাআঁকির আকাঙ্ক্ষা। তবু মনের ভেতর পুষে রেখেছিলেন শিল্পবোধের মিষ্টি অনুভূতির পাখিটা। বিশ্বাস, একদিন সেই পাখিটা পাখা মেলবেই।
বলছিলাম তরুণ শিল্পী মাহমুদ আল মাহদীর কথা। ২২টি চিত্রকর্ম নিয়ে মোহাম্মদপুরে ক্যাফে এম-এ আয়োজিত হয়েছে মাহদীর প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী ‘মিউটেশন’। ডিজিটাল মিডিয়ায় করা চিত্রকর্মগুলোর থিম হিসেবে শিল্পী বেছে নিয়েছেন vase অর্থাৎ পুষ্পাধার।
প্রদর্শিত কাজগুলোতে নির্দিষ্ট একটা থিম থাকলেও ভিন্ন ভিন্ন দ্যোতনা আছে তাতে। কিছুটা রহস্যময়, কিছুটা দ্ব্যর্থবোধক। বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতা যেন মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় প্রকাশিত। কাচ কিংবা মাটির পুষ্পাধার আমরা যেভাবে দেখি খালি চোখে, আমাদের যেন তা ভিন্ন চোখে দেখানোর চেষ্টা করেছেন শিল্পী। শিল্পের যাত্রায় নানা চড়াই-উতরাই। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা সারাক্ষণই একজন শিল্পীকে নতুন করে তৈরি হতে সাহায্য করে। সেযাত্রায় মাহদীর শুরুটাও প্রমাণ পাবে তাঁর কাজের ধারায়। শিল্পে তাঁর নিবিষ্টতা এবং ভালোবাসা নিয়ে তিনি কত দূর পাড়ি দেবেন, তা নির্ভর করছে তাঁর কাজের পরিক্রমার ওপর।
চিত্র সমালোচক শিল্পী মোস্তফা জামান মাহদীর কাজ সম্পর্কে মন্তব্য করলেন এভাবে, শিল্পজগতে আত্মপ্রকাশ সাম্প্রতিক হলেও মাহদী প্রতিশ্রুতিশীল। তাঁর কাজে প্রতিভার স্বাক্ষর আছে। শিল্পকর্ম উপস্থাপনায় তাঁর স্বকীয় শিল্পীসত্তার পরিচয় পাওয়া যায়।
মাহদীর জন্ম ১৯৮১ সালের ২০ জুলাই। ছোটবেলা থেকে আঁকাআঁকিতে ঝোঁক ছিল। ফাইন আর্টসে পড়ার আগ্রহ থাকলেও অভিভাবকদের ইচ্ছেয় পড়তে হলো ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। পেশা হিসেবে বেছে নিলেন কম্পিউটার গ্রাফিকস। পেশাগত কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলে ডিজিটাল মিডিয়ায় আঁকাআঁকির কাজ। প্রথমে শুধু নিজের মনের আনন্দের জন্যই কাজ করতেন। পরে গুণী শিল্পীদের কাছ থেকে প্রশংসা পেয়ে সাহস করে ফেললেন একক প্রদর্শনী করার।
মাহদী বললেন, আমার এই এক্সিবিশনের বিষয় হিসেবে আমি শুধু ‘Vas’ কে বেছে নিয়েছি। মূলত কোনো কিছু রাখার জন্য এটিকে ব্যবহার করা হয়। এটার যে আকৃতি এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা, তার কিছুটা পরিবর্তন, কিছুটা পারিপার্শ্বিক প্রতিরোধ বোঝানোর চেষ্টা ছিল। আমি এখানে সব ‘Vase’ এর ছবি ব্যবহার করেছি। রঙ-এর দিকে আমি ‘Vase’ এর রংগুলোকেই রাখার চেষ্টা করেছি। ছাপচিত্রের প্রক্রিয়াকে অনুসরণ করে একটির পর একটি লেয়ার দিয়ে যেভাবে কাজ করা হয়, আমিও ঠিক সেভাবেই কাজ করার চেষ্টা করেছি। ফটোশপে একটির পর একটি লেয়ার দিয়ে সাজিয়ে দেখে আমি আমার মূল কাজটি বের করার চেষ্টা করেছি। ডিজিটাল মিডিয়ায় কাজ করে আমি একটি সুবিধা গ্রহণ করেছি। যখন কোনো লেয়ারকে আমার মনে হতো এটি এই কাজের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করছে না, আমি সেটাকে মুছে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। যেটা প্রচলিত ছাপছিত্রে কিছুটা কষ্টসাধ্য।
নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে মাহদী বলেন- ‘ঢাকা আর্ট সেন্টারে ‘কিবরিয়া প্রিন্ট মেকিং স্টুডিও’তে আর্টিস্টদের কাজ করতে গিয়ে আর্ট-এর সঙ্গে বন্ধনটা নিবিড় হয়েছে আমার। কিছুটা আড়ষ্টতার কারণে প্রথম প্রথম দূর থেকে আর্টিস্টদের কাজ দেখতাম। আমার এই আড়ষ্টতা ভেঙে দেন আর্টিস্ট রুহুল করিম রুমি আর আর্টিস্ট ইমাম হোসেন। একদিন রুমি ভাই আমাকে রিলিফ প্রসেসে প্রিন্ট করার জন্য একটা মাউন্ট বোর্ড দেয়। সেখানে কীভাবে ড্রয়িং করতে হয়, ইমাম ভাই সেটাও দেখিয়ে দেন। প্রথম কাজের প্রিন্ট দেখে শিশির স্যারের উচ্ছ্বাস, শিল্পের সঙ্গে আমার সারা জীবন কাটানোর রসদ হিসেবেই থাকবে। শিল্পের পথে আমার নবযাত্রায় শিল্পী আবুল বারক আলভী এবং শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান বরাবরই অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। শিল্প সমালোচক ও শিল্পকলাবিষয়ক সাময়িকী ডেপার্টের সম্পাদক মোস্তফা জামানকে আমি আমার বিভিন্ন কাজ দেখিয়ে তাঁর মতামত নিতাম। তিনি আমাকে বিভিন্ন পরামর্শ দিতেন। চারুকলা বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকায় আত্মবিশ্বাসের যে অভাব ছিল, সেটা কিছুটা হলেও দূর হয়েছে বড় মাপের শিল্পীদের অনুপ্রেরণায়।’
গত ১৪ নভেম্বর প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিল্পী সৈয়দ আবুল বারক আলভী। এটি চলবে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন বেলা ১২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত।
পরের গীত গেয়ে গেয়ে পার কর...