by Amjad Akash, April 11, 2015 , In Graphic Design

মোনে’র নীলমণি হয়ে ওঠা : ধনী শিল্পসংগ্রাহকদের ভাষা

[metaslider id=1106]

monet4

।মাহমুদ আলম সৈকত। সথেবির নিলামঘরে প্রবেশ করে প্রথমেই আপনার চোখে পড়বে ক্লদ মোনের আঁকা ভেনিস গ্র্যান্ড ক্যানেলের চিত্রকর্মটি। চিত্রাভ নীল-সবুজ জল, অস্পষ্ট আকাশ এবং টিকরোলো মুক্তায় সাজানো সাদা গম্বুজের ‘ভাসমান শহর’, চট করে চেনা যায়, যে ইমেজটি বহুবহু বার ব্যবহৃত হয়েছে পোষ্টকার্ডে কিংবা তুলতুলে তোয়ালেতে। সথেবির ইম্প্রেশনিস্ট এন্ড মডার্ন আর্ট বিভাগের প্রধান হেলেনা নিউম্যান বলছেন, ‘ভেনিস ছিলো তাঁর (ক্লদমোনে) জন্য পরম কিছু; ভেনিসের আলো আর জলের খেলা তিনি যতটা বুঝতে পারতেন, এই চিত্রটি তার অনেকটুকুই ধারণ করে আছে।’

মোনে ভেনিস নিয়ে আঁকা শুরু করেন তাঁর ৬৮ বছর বয়সে। প্রতিদিনই, পায়ের কাছে ছলকানো জল আর পনেরোশো শতকের পালাযো বারবারোর চাতালে তিনি হাজির হতেন ইজেল নিয়ে। আঁকতেন ভেনিস যা ততদিনে ক্যানালেত্তো এবং টার্নারের বদৌলতে অবিস্মরনীয় হয়ে উঠেছিল। মোনের আঁকা ভেনিসের দৃশ্যাবলী বিষয়ে এক সহযোগী চিত্রশিল্পী’র বয়ান, ‘এই-ই আপনার শিল্পের সর্বোচ্চ প্রকাশ’। আজ মোনেতে আগ্রহী-অনুরক্তরা একটি ভিন্ন ভাষায় কথা বলেন। শিল্পকলা বিশ্বের অর্থনৈতিক চাকাকে সজোরে ঘুরিয়ে দেবার ক্ষেত্রে, নিশ্চিত বিনিয়োগ আর উচ্চমূল্যে চিত্রকর্ম বিক্রির নির্ভরযোগ্য এক নাম – ক্লদ মোনে। শিল্প বিশ্বের নীলমণি। গত বছর নিলামঘর সথেবি মোনের ‘ওয়াটার লিলি’ বিক্রি করেছে ৩১.৭ মিলিয়ন ইউরো, এই চিত্রকর্মটি এখনও পর্যন্ত মোনের একক কোনও ছবির দ্বিতীয় সর্ব্বোচ্চ মূল্য। নিলাম শুরুর মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যেই ছবিটির হাত বদল হয়। অবশ্য গত বছর এর চেয়েও বেশি দামে চিত্রকর্ম হাতবদল হয়েছে নিউইয়র্কে।

আলবার্তো গিয়াকোমেত্তির একটি ভাস্কর্য বিক্রি হয়েছে ৭৬ মিলিয়ন ইউরো। শিল্পী লুসিও ফনটানা তাঁর ‘কনসেত্তো স্পাজিআলে’ চিত্রকর্মটিতে যুদ্ধোত্তর যুগের দৃশকল্প এঁকেছেন। একটি উজ্জ্বল সাদা ক্যানভাসে তেইশটি এফোড়-ওফোড় করে দেয়া ঘাঁই – এটিই ‘কনসেত্তো স্পাজিআলে’। যার আনুমানিক মূল্য ধরা হয়েছে ৫ থেকে ৭ মিলিয়ন ইউরো। গেরহার্ড রিখটারের একটি ঝঞ্ঝামুখর জলপ্রপাতের বিমূর্তভাবনা, যা প্রায় ৮ ফুট লম্বা, ১৪ থেকে ২০ মিলিয়ন ইউরোয় বিক্রি হতে পারে। ২০১২ সালে এই ছবিটির কাছাকাছি অরেকটি ছবি ২১ মিলিয়ন ইউরোয় বিক্রি হয়। একজন জীবিত শিল্পীর জন্য এটি এখনও পর্যন্ত রেকর্ড পরিমান। বৈশ্বিক শিল্পকলার নিলাম ঘরগুলোর ২০১৪ সালের মোট বিক্রয় ১৬.১ বিলিয়ন ডলার, যা গতবছরের তুলনায় ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাল ২০০০ বা ২০০১ এ, নিউইয়র্কের যেকোনো নিলাম ঘর হরেদরে ৩০০ মিলিয়ন ডলার থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার ব্যবসা করেছে, বর্তমানে যা প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের আশেপাশেই আছে। শিল্পের বাজরটি যদি মুদ্রাস্ফীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হতো তাহলে আরও ৫৫০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন ব্যবসা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ইতিমধ্যে উন্নয়নশীল এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যেও শিল্পের বাজারটি হু হু করে বাড়ছে, বাড়ছে শিল্প সংগ্রাহকদের সংখ্যা। অপার আগ্রহ নিয়ে তারা ভীড় জমাচ্ছেন নিলামঘরগুলোয়।

গত পাঁচ বছরে ১২০টি দেশ থেকে সংগ্রাহকরা ভিড় জমিয়েছেন লন্ডনে, তাদের আগ্রহের বিষয় নিশ্চিতভাবেই চিত্রকর্ম, শিল্পকলা, গহনা বা বিশুদ্ধ সুরায়। ২০০৪ সালে সথেবির ডাকা মোনের একটি নিলামে এসেছিলো পাঁচটি দেশের শিল্প সংগ্রাহক, ২০০৯ এ এসে তা বারোটি, গতবছর (২০১৪) তা বেড়ে দাঁড়ায় উনিশে। প্রসঙ্গতই বলা চলে; গোটা দুনিয়ার ধণিক-নব্য ধণিক শ্রেণী যেনো একযোগে একটা ঐক্যমতে পৌঁছেছে, তা হলো, চিত্রকর্ম হলে তা হওয়া চাই ক্লদ মোনে নয় ভ্যান গগ নয়তো রিখটার, মদ হলে হতে হবে শাতেউ লেফিতে, গাড়ি হলে সেটা হওয়া চাই রোলস্ রয়েস নয়তো বেন্টলি।

মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়া থেকে ধনী ক্রেতাদের শিল্প বাজারে আগমন ২০০৮-০৯ এর আর্থিক মন্দার সময়টাতে। লেহ্ম্যান ব্রাদার্সের পতনের ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ইয়েভস সেন্ট লরেন্টের ব্যাক্তিগত সংগ্রহ মাত্র ৩৭৪ মিলিয়ন ইউরোয় হাতছাড়া হয়ে যায়, যা ধনীক শ্রেণীর অর্থনৈতিক ধ্বসের মর্মান্তিক চিত্র হিসেবেই পরিগণিত। আর্থিক মন্দার এক ঝরঝরে চিত্রই ছিল এই পতন। যখনই শিল্পের বাজারটি পাপড়ি মেলতে শুরু করলো, দেখা গেল বাজারে পর্যাপ্ত রসদ নেই! ধরা যাক, মোনের সাকুল্যে ছয়টি ছবিই সহজল্যভ্য, তখন বিষয়টি দাঁড়ালো খুব সহজ একেবারেই অর্থনীতির বইয়ের পাতায়লেখা সূত্রের মত -যোগান কম চাহিদা বেশি, ফলে মূল্যবৃদ্ধি। সুতরাং, শিল্পের বাজারে ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটলেও, শিল্পকর্মের যোগান বেড়েছে মাত্র দশমিক পাঁচ (০.৫) শতাংশ।

মিউজিয়াম এসোসিয়েশনের পরিচালক শ্যারন হোপ জানাচ্ছেন, শিল্প বাজার এমন ফুলেফেপে ওঠাটাও একটা অশনি সংকেতের মতো। এতে করে কিছু সমস্যাও এগিয়ে আসছে। এটা স্পষ্টভাবেই একটি চাপ, বাজেটের ওপর প্রভাব ফেলছে চাপ এবং চাপটি ঊর্ধ্বগামী হয়ে প্রদর্শশালাগুলোর উপর পড়ছে। উক্ত সমিতি দ্বারা পরিচালিত একটি সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে প্রতি ১০টি প্রদর্শশালা বা জাদুঘরের মধ্যে ১টিকে নানা আর্থিক চাপের কারণে তাদের সংগ্রহের অংশ বিক্রি করে দেওয়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করছে। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায়ও খুজতে শুরু করেছে এসোসিয়েশনগুলো। বাজেট কর্তন থেকে শুরু করে যৌথ অধিগ্রহণ, পাশাপাশি এসোসিয়েশনের জন্য চ্যারিটি তহবিল গঠনের কথাও ভাবা হচ্ছে। যাই হোক; দিগন্তে মেঘের বিস্তার ঘটছে। অর্থনৈতিক মন্দায়; রাশিয়া শিল্প বাজার থেকে একপ্রকার ছিটকে পড়েছে, ইউরোজোনজনীত সমস্যায় ভুগছে ইউরোপ, চীনের প্রবৃদ্ধি খুবই সামান্য। লন্ডন এক অর্থে অগ্নিপরীক্ষায় পড়েছে।

শিল্পসমালোচক-বিশ্লেষক থিয়েরি ডুমোলিন শোনাচ্ছেন আশারবাণী, ‘আমেরিকারর শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থান আর এশিয়ার বিস্তৃত সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই এই পতন ঠেকাতে পারে। সব বাজারই যেমন চক্রাকারে এগিয়ে যায়, শিল্পের বাজারও তার ব্যতিক্রম নয়। সুতরাং এখনই এ নিয়ে কোনও মতামত ব্যক্ত করাটা সমীচীন নয়। বরং আমরা আশা করতেই পারি যে সামনেই আছে শিল্পের বাজারের সুদিন। আপাতত, বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের ১ শতাংশ ক্লদ মোনের জন্য লগ্নি করে চলেছেন!

( দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে)

 

No Comments


Leave a Reply

Your email address will not be published Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

*