Warning: Trying to access array offset on value of type bool in /home8/amjahcom/public_html/wp-content/themes/photology-themes/lib/common-function.php on line 907
by Amjad Akash, January 26, 2015 , In Video Art

শতবর্ষের জয়নুল

 

zainul

। দীপ্তি দত্ত ।

শতবর্ষ বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পের দৃশ্যকাল না হলেও সুপ্তকাল সমেত একটা যোগফল বলা যেতে পারে। আবার জয়নুল এ বঙ্গের মাটিতে, শিল্প-ঐতিহ্যে আকস্মিক নয়- চন্দ্রাবতীর মাটির উত্তরাধিকার। তাই ব্রিটিশ দীক্ষিত আধুনিকতার মানদন্ডে কিশোরগঞ্জের নেটিভ বয়কে হঠাৎ আবিষ্কার করার মোহটা আমি এখানে রাখতে চাই না। ‘সংস্কৃতি’ ব্রহ্মপুত্রের জল-মাটি অস্বীকার করে কোনো পুঁথি বৈশিষ্ট্যে নির্মিত নয়। তাই এ কথাকে স্বীকার করতে হবে জয়নুলের শিল্পের প্রতি সহজাত মননশীলতাকে স্বীকার করতে হলে।

এদিক থেকে জয়নুলকে নতুন কোনো একটি ক্ষেত্রের নির্মাতা না বলে পোষক বলা যায়। তবে বলা যেতে পারে, শিল্পের ক্ষেত্রকেই তিনি আমাদের গম্য ইতিহাসের মধ্যে আরেকটি নতুন বৈশিষ্ট্যে রূপান্তরিত করেছেন। অর্থাৎ গ্রামীন শিল্পভাষা থেকে নাগরিক মানুষের শিল্পভাষার ক্ষেত্রে পরিভ্রমণ করেছেন বা লোকজ শিল্পের ধ্রুপদ ভূমিতে অভিজাত শিল্পভাষার প্রাণ বিংশ শতাব্দীর খোলা মাঠে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন।

জয়নুলের কাজে লোক, যেমন ফর্ম বা বিষয়ের অনুষঙ্গে প্রধান, তেমনি লোকজ শিল্পের কাজলরেখাই বিশেষায়িত হয়েছে আধুনিকতার অনুষঙ্গে। এখানে তিনি অপ্রাতিষ্ঠানিক হয়ে ওঠেন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে কোনো একটি শিল্প উপাদানের অনুপুঙ্খ একক ব্যবহারে। আর সেই উপাদানটি হলো রেখা। আমিনুল ইসলাম যেমন রেখাকে নাচিয়ে চলেন সচেতনভাবে রেখা নির্মাণের খোঁজেই। তিনি জানেন আধুনিক শিল্পভাষায় রেখা একক নির্মাণের অধিকারী এবং তিনি সাগ্রহে গ্রহণও করেন। কিন্তু জয়নুল দৃশ্যরূপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রেখাকে অধিকার করতে পারেন না বা কেবল রেখার দৃশ্যরূপ নির্মাণ করতে পারেন না। যদিও তিনি প্রকৃতি থেকে লোকজ শিল্পীর ন্যায় একাডেমিক শৈলীতে রেখার দ্বারাই নির্মাণ করেন পরিচিত ফর্ম বা বিষয়ের বিবরণ। যদিও দর্শকের চোখ বিষয় সচেতনতা কিছু সময়ের জন্য ভুলে গেলে দেখতে পাবে রেখারই দৌরাত্ম্য তাঁর কাজে। পল ক্লি’র মতো রেখা এখানে ধরন খুঁজে বেড়ায় না রেখার নিজের রূপের। জয়নুলের রেখা বিষয়ের খাঁজ অনুসন্ধান করে। জর্জ রোউল্টের মতো তার রেখা বিষয়ের পথ অবলম্বন করে নিজের বৈশিষ্ট্যে বস্তুর চরিত্রও নির্মাণ করতে চায় না। বস্তুর চরিত্রমাফিক এখানে রেখা অগ্রসর হয়। শিল্পের আঙ্গিকে জয়নুল তাই বাস্তববাদের অনুসারী নয়। বাস্তবে বস্তুতে রেখার অস্তিত্ব নেই। রেখা, আদিম মানুষের সহজাত সজ্ঞায় বস্তুর অবয়ব নির্মাণের একটি হাতিয়ার।

তাই বস্তুর সারাংশ অর্থে, রেখা প্রধান কাজকে সে ক্ষেত্রে অ্যাবস্ট্রাক্ট কাজ বলা যেতে পারে।

ইউরোপে প্রকৃতিবাদ থেকে বাস্তববাদের অন্বেষণে টোনের সঙ্গেই শিল্পীদের সখ্য নির্মাণের প্রয়াস লক্ষ করা যায়। তারপর আসে পরিপ্রেক্ষিত- পুরো ক্যানভাসে বাস্তব জগতের স্থানিক চেতনা নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা। জয়নুলের ভূ-দৃশ্যে এই বিষয়টিও প্রধান হয়ে ওঠে না। নদীর বাঁকের পর বাঁক নির্মাণ করে পরিপ্রেক্ষিত ও স্থানের অসীমতাকে ধরার প্রয়াস নেই। যত আছে নদ-নদীর একটি পরিচিত বাঁক ধরে জেগে ওঠা কাশবন বা জমে ওঠা নৌকার সারিকে রেখাপ্রধান দ্রুত তুলির লয়ে নির্মাণের চেষ্টা। এই বাঁক বা কাশবন বা এই মানুষ সুনির্দিষ্ট স্থান-কাল-পরিচয়ের চিহ্ন বহন করে তার ক্যানভাসে বর্তমান। স্থানিক চেতনা সর্ব অর্থেই আছে, তার ফর্মে সচেতন রেখার ব্যবহারে। সে ক্ষেত্রে আলোচ্য জাতীয় জাদুঘরের প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া জলরংয়ে করা ‘কুটির’ কাজটি ব্যতিক্রম। সেখানে শিল্পী রেখার পরিবর্তে রঙের মাধ্যমেই ক্যানভাসের পটভূমি ও ফর্ম নির্মাণ করেছেন। রংও ধূসর মাটির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কয়েকটি কাজে রঙের ব্যবহার দেখা গেলেও পুরো গ্যালারিকে ডিসকভারি চ্যানেলের তৃতীয় বিশ্বের নামতার দেশগুলোর সাদা-কালা মানুষের ভিড়ের পটভূমি বলেও মনে হয়।

জয়নুল নানা সময়ে নানা শিল্পরীতির সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয় পর্ব গড়ে তুলেছেন তার নিজস্ব শিল্প-ভাবনার পথ ধরেই। এই প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত শিল্পকর্মের দিকে সামগ্রিকভাবে তাকালে একটি বিশেষ শব্দই মনে হলো- তা হলো ‘ডকুমেন্টেশন’। ডকুমেন্টেশন উনি দুইভাবে করেছেন-

১.      সমাজ বাস্তবতার এবং

২.      নাগরিক শিল্প-ভাবনার স্বাভাবিকতার

জয়নুল যে আধুনিক নাগরিক শিল্প বাস্তবের ডকুমেন্টেশন করেছেন, তা তার শিল্পকর্মের ক্রনোলজিতে চোখ রাখলে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। যার কিছু নজির জয়নুল সংগ্রহশালাতেও আছে। ‘ডকুমেন্টেশন’ প্রক্রিয়াটি বোধ হয় ক্রমান্বয়ে জয়নুল মনস্তত্ত্বের প্রধান চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়। ফলে সমাজ বাস্তবতার যেমন ডকুমেন্টেশন করেছেন তেমনি শিল্পরীতিরও এক অর্থে ডকুমেন্টেশন করেছেন। একাডেমিক রীতি থেকে ইম্প্রেশনিজম, কিউবিজম হয়ে বিমূর্ত শিল্পরীতিতে পরিভ্রমণ করেছেন সচেতনভাবে। পঞ্চাশের দশকে ইউরোপ ঘুরে এসে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন লোকশিল্পের শৈলীকেও। অন্যদিকে তাঁর ছবিতে বিষয়বস্তু হিসেবে ‘৪৩-এর দুর্ভিক্ষ থেকে শুরু করে ব্রিটিশ শাসক, প্যালেস্টাইন, জর্ডান কায়রোর যুদ্ধপীড়িত মানুষ, এ দেশের রিকশাওয়ালা, মনপুরা যেমন আছে তেমনি আছে মৃত হনুমানের গল্পও। যখন যে দেশ ভ্রমণ করেছেন সেখানকার নগরদৃশ্য এবং মানুষের জীবনযাত্রার একটি সংক্ষিপ্ত খসড়া কম সময়ের মধ্যেও স্কেচে ধরে রাখতে চেয়েছেন। এই ধরে রাখার ইচ্ছেটাই স্কেচগুলোতে প্রবল- বিশেষ ঢঙ্গে শিল্পকর্মের বিশেষ কৌশল নির্মাণের প্রয়াসের চেয়ে। ফলে দেখা যায় শিল্পরীতির ক্ষেত্রে কোনো কিছুতে স্থিত হননি, কেবল নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই ছেড়ে গেছেন। বলা যেতে পারে শিল্পী হিসেবে কতকগুলো শৈল্পিক রীতির মধ্যে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। তার এই ভ্রমণভকে শিল্প আঙ্গিক ও চর্চার দিক থেকে একটি রেখায় দেখা যেতে পারে, যাতে এক বিন্দু পরিপ্রেক্ষিতের গভীরতা নেই।

যদিও শতবর্ষের এই আয়োজনে জয়নুলকে একসঙ্গে পাবার সুযোগ ঘটে না। এখানেও জয়নুল খন্ডিত। জাতীয় জাদুঘরে জয়নুলের যে বিশাল সংগ্রহের কথা জাদুঘরের কাগজে কলমে উল্লেখ আছে, তা প্রদর্শনীর মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠতে পারত। পুরো জয়নুলকে জাতীয় জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমীসহ উল্লেখযোগ্য গ্যালারিগুলোতে উন্মুক্ত করে দেওয়া যেত। বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পের যাত্রার বিন্দুকে- শতবর্ষের আয়োজনে কাঙ্ক্ষিত একটি পরিবর্তনের মাত্রায় দর্শকদের সামনে তুলে ধরার সুযোগ ছিল। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের গুরুত্ব প্রদর্শনীর দৃশ্যরূপে প্রতিফলিত হয়নি। আর দ্বিতীয় বিষয়টি হলো- এবারের প্রদর্শনীটি ঘুরে মনে হলো, এবার অন্তত স্পেস নিয়ে একটা সচেতন ভাবনা ছিল। কিন্তু ভাবনার জন্য যথার্থ ভাবুকের অনুসন্ধান করা হয়নি। লোকজ বিষয়ের উপস্থাপন বা লোক, জয়নুলের ছবিতে বিষয়বস্তু। তাই বলে আধুনিক নাগরিক শিল্পের এই পথিকৃৎকে উপস্থাপন করতে লোকজ কিছু ফর্ম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিলেই জয়নুল তত্ত্বের উপস্থাপন হয় না, বরং শতবর্ষে বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ের এই উপস্থাপনা- আধুনিক শিল্পের চরিত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। জয়নুল জন্মের শতবর্ষ সামনে রেখে জাতীয় জাদুঘরে আয়োজিত প্রদর্শনীটির পরিপ্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে, শতবর্ষের প্রগতির হিসাবের একমুখী সুযোগ এখানে নেই। বর্তমান বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে জয়নুল আবেদিনকে বিচার করতে হবে দুটি ভিন্ন ভিন্ন বিন্দু থেকে-

১.      বিশ্বশিল্পের পরিপ্রেক্ষিতে জয়নুলের শতবর্ষ।

২.      বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে জয়নুলের শতবর্ষ।

এ দুটি বিন্দুর যথার্থ বিচার-বিশ্লেষণ ও ফলাফলের সম্মিলনে পরবর্তী বাংলাদেশের আধুনিক শিল্প ও শিল্প-ভাবনা একটি স্বকীয় ও প্রতিনিধিত্বশীল বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারে।

No Comments


Leave a Reply

Your email address will not be published Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

*