[metaslider id=917]
।নূসরাত জাহান। ১৫০৪ সালের পর কোনও এক দিন। সৌন্দর্য নিয়ে তর্ক হচ্ছিল রেনেসাঁ যুগের বাঘা বাঘা কবি শিল্পীদের মধ্যে। সৌন্দর্য বলতে সবাই নারী বন্দনায় মুখর। ত্বক, চুল, চাহনী- নারীই যেন যাবতীয় সৌন্দর্যের আধার। আলোচনায় চুপচাপ শ্রোতা ছিলেন মিকেলেঞ্জেলো দি লোডোভিকো বুয়োনারোত্তি সিমোনি। এক পর্যায়ে আর টিকে থাকতে না পেরে বললেন, সবাই তো খুব নারীর গুণ গাচ্ছেন! সৌন্দর্য কাকে বলে দেখতে চান? আসুন আমার সঙ্গে। দেখো ডেভিডকে।
ডেভিড! মিকেলেঞ্জেলো নিজেই বলতেন সৌন্দর্যের প্রতিশব্দ হলো ডেভিড। শ্বেত পাথরে গড়া ১৭ ফুট উঁচু এ শিল্পকর্মটির দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় অনেক্ষণ। কী নারী, কী পুরুষ, ডেভিড সবার কাছেই সুন্দর, আকর্ষণীয়।
মিকেলেঞ্জেলোর জন্ম ১৪৭৫ সালের ৬ মার্চ। ৬ মার্চ ২০১৫ ছিল তার ৫৪০তম জন্মবার্ষিকী। ১৫০৪ সালে বয়স তার ২৯। ওই বছরেই শেষ হলো ডেভিড তৈরির কাজ। যার পেছনে খেটেছিলেন টানা ৪ বছর। ভাস্কর্য জগতের সেরা এমনি এমনি হয়নি ওটা। এই ডেভিডের কারণেই জীবিত থাকতেই রেনেসাঁর সেরা শিল্পী হয়ে যান মিকেলেঞ্জেলো।
শিল্পজগতের সব শাখা ছিল তার হাতের নাগালে। ছবি আঁকা, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, প্রকৌশল বিদ্যা এমনকি কবিতাও লিখেছেন মিকেলেঞ্জেলো। তবে বিখ্যাত হয়েছেন ডেভিড, পিয়েতা, রোমের সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদে ও দেয়ালে করা ফ্রেসকো কারনে।
শৈশবে ফ্লোরেন্সে এসেছিলেন ব্যাকরণ শিখবেন বলে। ভাষার আগেই তার ঝোঁক গিয়ে পড়লো চার্চের নকশায়। সেখানেই খুঁজে পান আসল ব্যাকরণ। কপি করতে শুরু করলেন গির্জার ছবি। ক্লাস করতে চাইতেন না। অন্য শিল্পীদের সঙ্গ খুঁজতেন সারাক্ষণ। এভাবেই একদিন আবিষ্কার করলেন নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকা ছাই চাপা আগুন।
১৪৯৬ সালে ২১ বছর বয়সে রোমে আসেন। ওই বছরই কার্ডিনাল রাফায়েল রিয়ারিওর অধীনে কাজ পেয়ে যান। ওই সময় মিকেলেঞ্জেলোর তৈরি একটি ভাস্কর্য বাতিল করেন ওই কার্ডিনাল। পরে ১৪৯৭ সালের নভেম্বরে হাতে পান পিয়েটা তৈরির কাজ। যিশুর নিথর দেহ ধরে ভার্জিন মেরির ক্রন্দন দৃশ্য। ১৫০১ সালে শুরু হয় গিল্ড অব উল-এর পৃষ্ঠপোশকতায় ফ্লোরেন্টাইন স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে বাইবেল নায়ক ডেভিডের মূর্তি বানানোর কাজ। ১৫০৪-এ শেষ হয় ডেভিড। ডেভিডে মুগ্ধ হয়ে কাউন্সিল একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। বত্তিচেল্লি ও লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ছিলেন ওই কমিটিতে। তাদের দায়িত্ব ছিল ডেভিডকে কোথায় বসানো যায় সেটা ঠিক করা।
১৫০৫ সালে রোমে নতুন পোপ জুলিয়াস দ্বিতীয় আসতেই ডাক পড়ে মিকেলেঞ্জেলোর। পোপের সমাধিটা বানিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে কাঁধে। থাকতে হবে ৪০টি ভাস্কর্য। শেষ হতে হবে ৫ বছরেই। সেই সমাধিটাই মিকেলেঞ্জেলোর জীবনে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে যায়। ৫ বছরে কিছুতেই শেষ করতে পারেন না কাজ। এখানে কেটে যায় শিল্পীর জীবনের ৪০টি বছর। ১৫১৬ সালে এই টম্বের মাঝেই তৈরি হয় মোসেসের একটি মূর্তি। মাঝের চার বছর (১৫০৮-১৫১২) লাগে শুধু সিস্টিন চ্যাপেলের দেয়ালের ছবিগুলো আঁকতেই।
কালের বিবর্তনে দ্য হিরোইক ক্যাপটিভ আর ডায়িং ক্যাপটিভ চলে যায় ল্যুভ জাদুঘরে। ফ্রেসকোগুলো আছে জায়গামতোই। এর মাঝে বদলে যায় পোপেরা। বদলায় না মিকেলেঞ্জেলোর সৃষ্টির নেশা। লরেঞ্জো দ্য ম্যাগনিফিসিয়েন্ট-এর পৃষ্ঠপোশকতায় তৈরি করেন মেডিচ্চি চ্যাপেল। মেদিচ্চি পরিবারের দুটো বড় সমাধি আছে এর ভেতর।
রোমে মিকেলেঞ্জেলো থাকতেন সান্তা মারিয়া দি লরেতো চার্চে। ওই সময় তার সঙ্গে পরিচয় হয় কবি ভিতোরিয়া কলোনার। মৃত্যুর (১৫৪৭) আগ পর্যন্ত ওই ভিতোরিয়াই ছিলেন মিকেলেঞ্জেলোর সবচেয়ে কাছের বন্ধু। এর কিছু দিন আগে ১৫৩৪ সালে পোপ ক্লিমেন্ট অষ্টম মিকেলেঞ্জেলোকে কমিশন দেন দ্য লাস্ট জাজমেন্ট ফ্রেসকো তৈরির। ৭ বছর লাগে ওটা শেষ করতে।
শিল্পী জীবনে যেমন পরিশ্রমী ছিলেন তেমনি ব্যক্তিজীবনে ছিলেন মিতব্যয়ী। নিজেই বলতেন, আমি যতই ধনী হই না কেন, সারাজীবন গরিবি হালেই থেকেছি। তবে ইতিহাস তাকে গরিব রাখেনি। ভিঞ্চির চেয়ে ২৩ বছরের ছোট এ শিল্পীকে সরাসরি রেনেসাঁযুগের সেরা না বললেও তাকে ছাড়া অধরাই থেকে যাবে মানবসভ্যতার একটি বড় অধ্যায়।
No Comments