Warning: Trying to access array offset on value of type bool in /home8/amjahcom/public_html/wp-content/themes/photology-themes/lib/common-function.php on line 907
by Amjad Akash, January 12, 2015 , In Illustration

সংস্কারে ঐতিহ্য হারালো অপরাজেয় বাংলা

[metaslider id=4]
। মুনিরুদ্দিন আহমেদ তপু।

এই লেখা লিখতে গিয়ে মারাত্মক আবেগ তাড়িত ছিলাম। অপরাজে বাংলা সংস্কার করে সাদা করা হয়েছে। এই ঘটনাটা জানার পর থেকেই বারবার মনে পড়ছিল ছেলেবেলায় ইট-মাটি-বাঁশ দিয়ে শহীদ মিনারের অনুকৃতি বানানোর মতোই স্কুলে বা মহল্লার বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সারা গায়ে কাদা লেপে কাঠের বন্দুক নিয়ে ‘অপরাজেয় বাংলা’ সাজার দিনগুলো। মনে পড়ছিল ২০০৮ সালে বিমানবন্দরের সামনে ‘বাউল ভাস্কর্যের নামে’ নির্মাণাধীন স্থাপনা ভেঙে ফেলার পর গড়ে ওঠা ‘বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন’-এর কথা। সেদিন আমরা বলেছিলাম ‘শিল্পচর্চার মুক্ত পরিবেশ চাই’। পাশাপাশি আমরা ‘জনপরিসরে স্থাপত্য-ভাস্কর্য নির্মাণ ও সংরক্ষণের নীতিমালা প্রণয়ন’সহ আরও অনেক প্রাসঙ্গিক দাবি তুলেছিলাম। সেগুলো বাস্তবায়ন হলে হয়তো আজ আমাদের এই দুর্গতি হতো না। সেদিন আমরা বলেছিলাম—শুধু প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আন্দোলন দিয়ে এই সমস্যা দূর করা যাবে না। এজন্য চাই নির্মাণের আন্দোলন। তাই ‘শিল্প নির্মাণ করেই শিল্প ভাঙার প্রতিবাদ’ করতে গিয়ে আমরা আমরা সেদিন এই ‘অপরাজেয় বাংলা’কেই প্রতীক হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম, এর বিশাল অনুকৃতি নির্মাণ করেছিলাম। কেননা অপরাজেয় বাংলা সেই ভাস্কর্য যা এদেশের মানুষকে ভাস্কর্যের প্রতি অনুরক্ত করেছে, শিল্পের এই মাধ্যমকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে।

শিল্প তো তাই যা মানুষ জীবন দিয়ে নির্মাণ করে, যা জীবনকে জাগিয়ে রাখে। বায়ান্নে বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়ে এদেশের মানুষ শহীদ মিনার নির্মাণ করেছে। একাত্তরে বাংলা দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে মানুষ প্রমাণ করেছিল বাংলা অপরাজেয়। সদ্য স্বাধীন দেশে জাতীয় মুক্তির সেই সংগ্রামী চেতনাকে জাগ্রত রাখতেই মুক্তিযুদ্ধের এই স্মারক ভাস্কর্য নির্মাণ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র-তরুণরা। সেদিনের তরুণ ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ সেই চেতনাকে শিল্পে মূর্ত করেছিলেন। সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী চেতনাকে মূর্ত প্রতীকে ধরে রাখা বা ভাস্কর্য নির্মাণের পক্ষে পত্রিকায় লিখে একে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অপরাজেয় বাংলা’ বলে। সেই নাম থেকেই আজকে দেশে মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে পরিচিত স্মারক ভাস্কর্যটি হয়ে ওঠে অপরাজেয় বাংলা।

যে সংগ্রামী চেতনাকে জাগ্রত রাখতে ভাস্কর্য গড়তে চাওয়া, স্বাধীন দেশেও অনেক সংগ্রাম করেই তা প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পালা বদলে মৌলবাদীদের বিরোধিতার কারণে বার বার কাজ বন্ধ থাকায় অপরাজেয় বাংলার নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং তা উদ্বোধন হয় ১৯৭৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর। শিল্পী, উদ্যোক্তা ছাত্র-ছাত্রী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজের অবিচল প্রত্যয়ে নির্মাণের পর থেকেই দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায় ভাস্কর্যটি। আশির দশকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র-গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলন সংগ্রামের আঙিনায় পরিণত হয় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ। সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে। ফলে আমাদের মানসপটে অপরাজেয় বাংলার অনুপ্রেরণার যে ছবিটা গাঁথা তা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মতোই আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতেরও বৈকি।

জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক হয়ে ওঠা শিল্পকর্ম যুগে যুগে দেশে দেশে মানুষকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। আমাদের দেশেও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম চোখের সামনে অপরাজেয় বাংলার ছবি নিয়েই বেড়ে উঠেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই সারা দেশের ছাত্র সমাজ ও মানুষের কাছে অপরাজেয় বাংলা পৌঁছে গিয়েছে বহু আগেই। বছরের পর বছর ধরে ক্যালেন্ডারের পাতায়, পোস্টারে, স্কুলের খাতায়, ছোট কাগজের প্রচ্ছদে, বার্ষিকী-সাময়িকীতে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ সজ্জায় আর লাখো অনবদ্য আলোকচিত্রে ফুটে আছে অপরাজেয় বাংলার মুখ।

কবি-সংগীত শিল্পী কফিল আহমেদ যেমন বলেন, ‘অপরাজেয় বাংলা আমাদের চেতনার সেই জাগ্রত শিল্প যা এদেশের মানুষের সংগ্রামে প্রত্যয়ে সব সময় আমাদের জাগিয়ে রাখছে। যা কিনা এদেশের মানুষেরই মুক্তিপ্রাণ মুখ। সেই মুখ ঢেকে দেওয়া কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না, সেই মুখ আমাদের চোখের সামনে স্পষ্ট থাকুক।’

কিন্তু অসচেতনতার কারণে এমন জাতীয় ঐতিহ্য হয়ে ওঠা শিল্পকর্মের প্রকৃত রূপ নষ্ট করে ফেলা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত মর্মান্তিক। সম্প্রতি সাদা সিমেন্টের প্রলেপে ঢেকে দেওয়ায় ভাস্কর্যটির অবয়বে এতদিন গুঁড়ো পাথর ও সিমেন্টের মিশেলে মোজাইকের মতো যে ‘টেক্সচার’ দেখা যেত, সাদা সিমেন্টের প্রলেপের কারণে তা পুরোপুরি ঢাকা পড়ে গেছে। এভাবে সিমেন্ট লেপার কারণে দুই তরুণ ও এক তরুণী মুক্তিযোদ্ধার দৈহিক গড়নের খোদাইকরা ‘ডিটেইল’ গুলোও অনেকটা ম্লান হয়ে গেছে। স্তরে স্তরে ঢালাইয়ের চিহ্ন বহনকারী বাঁকগুলোও কিছুটা মিশে গেছে। ফলে সাদা রঙের ভাস্কর্যটি দেখতে এখন অনেকটা ‘শোলার পুতুলে’র মতো ওজনহীন মনে হয় এবং এর পরিচিত বলিষ্ঠতা ও গাম্ভির্যও কমে গেছে।

যে ভাস্কর তাঁর যৌবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বছরের পর বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই ভাস্কর্য গড়েছিলেন তাঁর হাত দিয়েই এই অসচেতন ‘সংস্কার’ কাজের ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। এক্ষেত্রে শিল্পী, প্রকৌশলী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চরম অসচেতনার প্রমাণ দিয়েছেন। যে বিষয়টা সবারই বোঝা দরকার তা হলো ‘সংরক্ষণের নৈতিকতা’। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক লালা রুখ সেলিমের বক্তব্য আপনাদের জানাতে পারি। তিনি মনে করেন, ‘শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে কারিগরি ও নৈতিক দুটো দিকই ভাবতে হবে। সংরক্ষণ মানে তা কেবল যে কোনো প্রকারে টিকিয়ে রাখা নয়, প্রকৃত অবস্থায় টিকিয়ে রাখা। যে নির্মাণ সামগ্রীতে, কারিগরি প্রকৌশলে, রীতিতে তৈরি হয়েছে তা টিকিয়ে রাখা। যাতে পরবর্তী প্রজন্ম বুঝতে পারে নির্মাণকালে এর প্রযুক্তি, নন্দন তাত্ত্বিক উত্কর্ষ ও সৌকর্য কী ছিল।’

সিমেন্টের প্রলেপ সম্পর্কে ভাস্কর লালা রুখ সেলিম বলেন,‘এটা ভাস্কর্যটির একটা হাত-পা ভেঙে যাওয়ার চেয়ে কম মারাত্মক নয়। কেননা এতে ভাস্কর্যটির প্রকৃত অবয়ব ঢাকা পড়ে গেল। সংরক্ষণের নৈতিকতার কারণে যতটুকু সম্ভব প্রকৃত অবস্থা বজায় রাখার চেষ্টা করা উচিত। স্থাপত্য-ভাস্কর্য ইত্যাদি পুরোটা ভেঙে নতুন নির্মাণ কিংবা রং বা সিমেন্টের প্রলেপে ঢেকে দেয়া ঠিক না। মেরামত বা সংস্কার কাজ যদি দৃশ্যমানও থাকে তবুও পুরোটা নতুন না বানিয়ে দুয়ের মধ্যে সাজুয্য রাখার চেষ্টা করা দরকার।’

পাশাপাশি শিল্পকলা সংরক্ষণের বিষয়ে যা মাথায় রাখা জরুরি তা হলো—কোনো শিল্পীর শিল্পকর্ম শিল্পী বা কারও ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকলে তা তাঁরা নিজেদের ইচ্ছে মতো সংস্কার করতে বা ভাঙতে-গড়তে পারেন। কিন্তু কোনো শিল্পকর্ম যদি দেশের মানুষের বা জনগণের হয়ে ওঠে তা সংরক্ষণ এবং সংস্কার তখন সবার সামষ্টিক দায়িত্ব। নিয়মিত দেখভালের বাইরে শিল্পী নিজে বা যে প্রতিষ্ঠানে তা আছে তারা এককভাবে এর কোনো বড় পরিবর্তন বা সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এজন্য অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের ডেকে প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় সহায়তা নেওয়াটাই রীতি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ‘অপরাজেয় বাংলা’ সংস্কার করতে গিয়ে এ বিষয়গুলো কারও মাথাতেই আসেনি! এখন প্রশ্ন হলো এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা এমন জাতীয় ঐতিহ্যগুলো রক্ষায় সচেতন হবো কি না। আমাদের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এ বিষয়ে মনোযোগী হবে কি না। আর সবচেয়ে বড় কথা ‘অপরাজেয় বাংলা’-কে প্রকৃত রূপে ফিরিয়ে নিয়ে আমরা তা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে পারবো কি না?

No Comments


Leave a Reply

Your email address will not be published Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

*